‘তাজউদ্দীন সাবের বাড়ি’

বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামেপ্রথম আলো

গোসিংগা ঘাটের মাঝি জামাল উদ্দিন। তরুণ বয়স। নৌকা ভাসিয়েছেন শীতলক্ষ্যার জলে। সকাল নয়টায় তাঁর নৌকায় অচেনা চার তরুণ। পঞ্চম আগন্তুক আমিও যুক্ত হলাম। জামাল মাঝি অচেনা চার তরুণকে আঙুলের ইশারায় দেখাচ্ছিলেন, ‘ওই তো তাজউদ্দীন সাবের বাড়ি।’ উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকাচ্ছিলেন তাঁরা।

মাঝি গল্প শুরু করলেন, ‘উনি একজন মানুষই আছিন। বাপ–দাদার কাছে হুনছি ওনার কথা। আমগর দেশের রত্ন অছিন।’ ওই চার তরুণ মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তাঁর কথা। মাঝির চেহারায় রাজ্যের গর্ব। তিনি বলেন, ‘দিনে না অইলেও ৫০-৬০ জন মানুষ তো আমিই পার করি। তারা দেশের বিভিন্ন জেলা থেইক্কা আসে তাজউদ্দীন সাবের বাড়ি দেখতে, ছবি তুলে।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঝির নৌকা গোসিংগা ঘাট ছাড়িয়ে দরদরিয়া ঘাটে গিয়ে থামে। নৌকা কোনোমতে বেঁধে ওই চারজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নদীর পাড়ে ওঠেন। দেখিয়ে দেন কোন পথে যেতে হবে ‘তাজউদ্দীন সাবের’ বাড়ি। এ ‘তাজউদ্দীন সাব’ হলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর জন্মভিটা গাজীপুরের কাপাসিয়ার রায়েদ ইউনিয়নের দরদরিয়া গ্রামে।

মৌলভি মোহাম্মদ ইয়াসিন খান ও মেহেরুন্নেসা খানমের চার ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে তাজউদ্দীন ছিলেন চতুর্থ। জন্মের পর এখানে একটি দোতলা বাড়িতেই শৈশবের অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন তিনি। এ বাড়িতেই ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই জন্ম তাঁর। পরে সারা পৃথিবী দেখল একেবারে গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ছেলেটির সাহস। তাজউদ্দীন ছিলেন স্বাধীনতা-পূর্ব ও স্বাধীনতা–পরবর্তী বাংলাদেশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।

শ্রীপুরের গোসিংগা ঘাটে শীতলক্ষ্যা নদী পেরিয়ে পূর্ব দিকে কাপাসিয়ার দরদরিয়া খেয়াঘাট। সেখানে ২৫০ মিটারের মতো হাতের বাঁ দিকে তাজউদ্দীনের জন্মভিটা। কাপাসিয়া সদর থেকে এখানে আসতে পাড়ি দিতে হবে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরত্ব। কাপাসিয়া সদরে এসে কাপাসিয়া-টোক সড়ক ধরে উত্তর দিকে যেতে হবে দুই কিলোমিটার। সেখানে মিয়ার বাজার থেকে পশ্চিম দিকে রাস্তা নেমে গেছে দরদরিয়া। সুনসান নীরব গ্রামের ভেতর দিয়ে পাখির ডাক শুনতে শুনতে আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে চলে যাওয়া যায় দরদরিয়া গ্রামের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে।

সম্প্রতি তাজউদ্দীনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থীরা এসেছেন। বাড়িটিতে তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন তাঁরা। নৌকার মাঝির সঙ্গে গল্প করা সেই চার তরুণও এসেছেন। তাঁরা ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি দেখতে এসেছেন। এখানে তিনি কোথায় বসতেন, কোথায় ঘুমাতেন বা কোন স্কুলে পড়তেন—দর্শনার্থীরা এমন উৎসুক প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করেন আশপাশের লোকজনের কাছ থেকে। তবে খুব দরদ দিয়ে তাজউদ্দীন আহমদের স্মৃতিগুলো দর্শনার্থীদের দেখান বাড়ির পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম। ক্যামেরায় ছবি তুলতে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন তাঁর পাঁচ বছর বয়সী নাতনি আলমিকা ইসলামকে। হাত ধরে নিয়ে গেলেন একটি ঘরের কাছে। বললেন, এখানেই জন্ম হয়েছিল তাজউদ্দীনের। তিনি জানালেন, প্রতিদিন শ দেড়েক মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই বাড়ি পরিদর্শনে আসেন। তাঁরা বাড়ির ভেতরে বাইরে ঘুরে দেখেন।

তাজউদ্দীনের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটিতে বর্তমানে একটি দোতলা মাটির ঘর আছে। ঘরটির পশ্চিম পাশে আরও একটি দোতলা ঘর ছিল। কিন্তু সেটি একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দেয়। পুড়ে যাওয়া ঘরটির জায়গায় একটি ঘর তৈরি করা হয়। এর পশ্চিম পাশে আরও একটি মাটির ঘর আছে। তাজউদ্দীন রাজনৈতিক জীবনে যতবার গ্রামের বাড়ি গেছেন, ততবার এই মাটির ঘরে বসেই লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এটি পরিচিত বাংলাঘর নামে। দোতলা ঘরের পশ্চিম দিকের উঠানের এক পাশে কৃষিপণ্য রাখার গোলাঘর, এক পাশে রান্নাঘর। দোতলা ঘরের ভেতর থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে সেখানে চোখে পড়বে তাজউদ্দীনের ব্যবহৃত চেয়ার ও ছোট্ট একটি টেবিল। আছে বিছানা ও বিভিন্ন আসবাব। পূর্ব দিক ফেরানো ঝুলবারান্দা। সেখানেও চেয়ার পাতা। ঝুলবারান্দা থেকে পূর্ব দিকে তাকালে চোখে পড়বে বড় গাছগাছালিবেষ্টিত পুকুর। ঘরটির দোতলার পশ্চিম দিকেও আছে বিশাল বারান্দা। সেখানে কাঠের রেলিং। বাড়ির ভেতর উঠানের চারপাশে নানা জাতের ফুলগাছ। দোতলা বাড়ির রান্নাঘর লাগোয়া দাঁড়িয়ে আছে বিলম্বিগাছ। এ ছাড়া দোতলা ঘরটির পূর্ব পাশে আছে কিছু লিচুগাছ। বাড়িটি ও বাড়ির সামনের পুকুর ঘিরে আছে নারকেল, সুপারি, আম, জাম, কাঁঠাল, বটসহ অন্তত অর্ধশত প্রজাতির গাছ।

স্থানীয় দুজন বাসিন্দা বলেন, তাজউদ্দীনের স্ত্রী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন গাছ খুব পছন্দ করতেন। তিনি তাঁর বাড়ির আঙিনা শত শত গাছ দিয়ে সাজিয়েছেন। এগুলো পরিচর্যার জন্য আগে পাঁচ-ছয়জন লোক কাজ করতেন। এখন এ বাড়িতে তাজউদ্দীনের উত্তরসূরিরা কেউ থাকেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে তাঁর বাবা ও মা তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি দেখাতে নিয়ে এসেছেন। তাঁদের মধ্যে একজন নাফিসা তাবাসসুম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে এলে ভালো লাগে। গর্ব হয় এটা ভেবে, তাজউদ্দীন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি আমাদের এ মাটির মানুষ। ওনার স্মৃতিবিজড়িত এ বাড়ি আমাদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য “ইনস্পিরেশন”। এবার ছোট বোন সায়মা সালসাবিলকে বাড়ি দেখাতে নিয়ে এসেছি।’

সায়মা সালসাবিলও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘এখানে এসে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টির শুরুর সময়টাকে ছুঁয়ে ফেলেছি। মনে হচ্ছে সেই সাহসী মানুষটিকে সামনে থেকে অনুভব করছি।’

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থেকে বাড়িটি দেখতে এসেছেন সাজ্জাদ কবীর। তিনি বলেন, এই বাড়িটিকে বিশেষভাবে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন। তিনি গাজীপুর-৪ আসনের বর্তমান সাংসদ। তাঁর বাবাকে নিয়ে শৈশবের একটি স্মৃতিচারণা করেন এই প্রতিবেদকের কাছে। তিনি বলেন, ‘বাবা গ্রামের বাড়িতে গেলে সেখানে মাটির তৈরি বাংলাঘরে লোকজনকে নিয়ে আসতেন। বাবা বাড়ি এলে আশপাশের সাধারণ মানুষের সে কী আনন্দ! একাত্তরে আমাদের গ্রামের বাড়িতে ঘর পুড়িয়ে দেয় পাকিস্তানি হানাদারেরা। তখন গ্রামের কয়েকজন লোক বাবার জন্য পুরাতন টিন দিয়ে ছাপরা তৈরি করেন। বাবার অসংখ্য স্মৃতি আমাদের এখনো মনে পড়ে। বাড়িতে যে গাছপালা, এগুলোর সব আমার মায়ের হাতে লাগানো। মা গাছ পছন্দ করতেন। বাবা সব সময় মায়ের এ প্রকৃতিপ্রেমকে উৎসাহিত করতেন।’

তাজউদ্দীনের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ বলেন, ‘আমাদের গ্রামের বাড়ি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলার লোকজন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর জন্মভূমি দেখার জন্য সেখানে যান। পারিবারিকভাবে পরিকল্পনা আছে সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ স্মৃতি জাদুঘর গড়ে তোলার। সেখানে গিয়ে যেন লোকজন তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে পারেন।’