সড়কের মৃত্যুগুলো কেন শুধু সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে

বাসচাপায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান নিহত হওয়ার পর রাস্তায় নেমেছিলেন শিক্ষার্থীরা, নিরাপদ সড়কের দাবিতে তিন বছর আগেও ঢাকায় ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তারা। সে সময় সরকারের পক্ষ থেকে নিরাপদ সড়কের জন্য পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর রামপুরায় বাসচাপায় মারা যাওয়া মাইনুদ্দিনের বাবা আবদুর রহমানের কান্নার ছবিটা দেখে মনে পড়ল রোকসানা বেগমের কথা। রোকসানা বেগমও সন্তানহারা এক মা। তাঁর ছোট মেয়ে দিয়া খানম মীম ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বাসের চাপায় মারা গেছেন। দুই বছর আগে দিয়াদের বাসায় কথা হয় রোকসানা বেগমের সঙ্গে। দিয়ার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন পরিবারের সদস্যরা। মেয়ের কবরের দিকে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকেন রোকসানা বেগম।

দেশে এখন প্রতিদিন এমন অসংখ্য আবদুর রহমান, রোকসানা বেগম তৈরি হচ্ছে। যাঁদের সন্তান, স্বজন, আপনজন মারা যাচ্ছেন সড়ক দুর্ঘটনায়। পরিবারগুলোর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন মুহূর্তে পিষে যাচ্ছে ঘাতক বাহনের চাকায়। স্বজন হারানোর এই কষ্ট আজীবন বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরিবারকে। কিন্তু জবাবদিহিহীনতার সংস্কৃতির কারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিদের হয়তো এই কষ্ট স্পর্শ করে না।

দীর্ঘদিন ধরে চলা সড়কের বিশৃঙ্খলা আর অনিয়ম দেখে মনে হয়, সরকারি দপ্তরগুলোর কাছে সড়কে ঝরে যাওয়া তাজা প্রাণগুলো শুধুই সংখ্যা। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক হিসাবে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৭ হাজার ১৭০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৮২ হাজার ৭৫৮ জন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল। প্রশ্ন জাগে, এত মৃত্যুও কেন সরকারের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্ববোধ জাগাতে পারে না?

দীর্ঘদিন ধরে চলা সড়কের অনিয়মের বিরুদ্ধে সাড়ে তিন বছর আগে প্রতিবাদমুখর হয় আমাদের তরুণসমাজ। রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে বেপরোয়া বাসের চাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় শুরু হয় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন। টানা ৯ দিন ধরে চলা তারুণ্যের সেই বিক্ষোভে সমর্থন ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের। কারণ, সড়কে প্রতিনিয়ত যে প্রাণ ঝরছে, তার মধ্যে শিক্ষার্থী ছাড়াও নানা বয়সের মানুষ রয়েছেন। তবে গবেষণা বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতদের মধ্যে কর্মক্ষম বয়সের (১৫ থেকে ৪৫ বছর) মানুষই বেশি। অর্থাৎ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিবারের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এর প্রভাব অপরিসীম।

ওই সময় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। নয় দফা দাবি আদায়ে রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করেই শিক্ষার্থীরা সড়কে থাকে। তাদের আন্দোলন থামাতে ‘হেলমেট বাহিনী’ দিয়ে পেটানো হয়েছিল, মামলা হয়েছিল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা দমে যায়নি। সরকার বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে ৯ দফা দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয়। আশ্বাস পেয়ে ঘরে ফেরে শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু গত সাড়ে তিন বছরে সড়কের পরিস্থিতিতে কী বদল হয়েছে? সরকারি সংস্থাগুলো বলেছিল, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আদতেই কি সেই চোখ খুলেছিল? এই সময়ে সরকারের এমন কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি, যাতে মনে হয় সরকার সড়কের মৃত্যুর মিছিল থামাতে আন্তরিক। বরং এই সময়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের দাবির মুখে একাধিকবার সরকারকে পিছু হটতে দেখা গেছে। সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের ঘোষণা দিয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সরকার। উল্টো মালিক-শ্রমিকদের আইনের ৩৪টি ধারা সংশোধনের প্রস্তাবের মধ্যে ২৯টিকে আমলে নিয়ে সংশোধনের সুপারিশ করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গঠিত কমিটিও নানা নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা প্রতিশ্রুতি দিলেও সে অনুযায়ী কাজ না করাতেই সড়কের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি রয়ে গেছে, মৃত্যুর মিছিলও থামেনি। এর ফলে দেখা যাচ্ছে, নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবার রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা।

বর্তমান সরকার টানা ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়। দেশ স্বাধীনের পর থেকে টানা এত বছর কোনো সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগের নির্বাচনী ইশতেহারে রাজধানীকে যানজটমুক্ত করা এবং গণপরিবহন সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আওয়ামী লীগ।

বর্তমানে সড়কের পরিস্থিতি দেখে সহজেই বোঝা যায়, এই প্রতিশ্রুতি পূরণে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে বর্তমান সরকার। এই সরকারের কাছ থেকে এত বছর পর এসে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে নির্দেশনা আসা বা কী করতে হবে, তা ঠিক করার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে কষ্ট হয়। অথচ এত দিনে সড়ক খাতকে শৃঙ্খলায় এনে যাত্রী, পথচারীসহ সবার জন্য নিরাপদ করা অসম্ভব ছিল না।

নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতে করণীয় কী, সেটা অজানা নয়। সময়ে–সময়ে জনগণের টাকা খরচ করে সড়কসংশ্লিষ্ট বিস্তর নির্দেশনা, পরামর্শ প্রস্তুত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ও অধিকারকর্মীদের মতে, সড়কের সমস্যাটি এখন হয়ে গেছে রাজনৈতিক। শুধু কারিগরি দিক থেকে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। তাই সড়ককে নিরাপদ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছার।

গত ১৩ বছরে রাজধানীর যানজট কমার বদলে আরও বেড়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে, ১২ বছর রাজধানীতে যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। আর এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে গড়ে ৫ কিলোমিটারে। আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি যানজটের ফলে যাত্রীদের ওপর অসামান্য মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। যানজট হ্রাসে কয়েকটি উড়ালসড়ক নির্মাণ ছাড়া তেমন অগ্রগতি নেই। অথচ রাজধানীতে সরকারি ব্যবস্থাপনায় বাস চালুর পরামর্শ দেওয়া হলেও এই বিষয়ে সরকার নির্বিকার।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থামাতে সরকার তাদের দুই-একটি দাবি মানার প্রতিশ্রুতি দিলে হয়তো আন্দোলন আপাতত ঠান্ডা করা যাবে, কিন্তু মূল সমস্যা থেকেই যাবে। তাই সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। পরিবহন খাতে মালিক-শ্রমিকদের প্রভাব না কমানো গেলে কিছুদিন পরপর নানা দাবিতে ধর্মঘটের নামে জনভোগান্তি তৈরির সংস্কৃতি বন্ধ হবে না, সড়কে শৃঙ্খলাও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।

এবার নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ফার্মগেট এলাকায় এক ছাত্রীর হাতে ধরা একটা প্ল্যাকার্ডে চোখ আটকে যায়। তাতে লেখা ‘অ্যাম আই নেক্সট’ (এরপর কি আমি)। এর জবাব কী হতে পারে? কে দেবে এই প্রশ্নের জবাব? কত বাবা-মায়ের বুক খালি হলে সড়কের মৃত্যুগুলো শুধু সংখ্যা হিসেবে গণ্য হবে না? আর কত পরিবার দুর্ঘটনায় স্বজন হারিয়ে নিঃস্ব হলে কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে।