তারুণ্যের উদ্যমে মানবতার জয়গান

‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’কে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন সনদ তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’কে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন সনদ তুলে দিচ্ছেন স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত

‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে’ মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে পথ চলছে একঝাঁক উদ্যমী কিশোর। শুরুটা একেবারে ভিন্নভাবে। মুমূর্ষু এক রোগীর রক্তের প্রয়োজনে বন্ধুর অনুরোধে ভয়ে ভয়ে সাড়া দেয় আরেক বন্ধু। রক্তদানের চিত্র তুলে ধরে ফেসবুকে। ফেসবুকের হাওয়ার বেগ প্রকৃতির বেগের চেয়ে বোধকরি বেশি! নইলে ওই রক্তদাতাকে দেখে কেন উদ্বুদ্ধ হবে অনেকেই! পরের এক মাসে প্রায় ১৫ জনকে রক্ত দেয় বন্ধুরা। নিতান্তই শখের বশে বাঁচিয়ে তোলে ১৫ প্রাণ। সেই থেকে যাত্রা শুরু।

সময়ের ক্যালেন্ডারে দিনটি ২০১৭ সালের ২৯ মে। কয়েকজন মিলে পথচলা শুরু করায় ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের। কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার লাকসাম সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্রদের ভাবনার ডালপালা বিস্তৃত হয়ে ছুঁয়েছিল আকাশ। প্রথম দিকে কেবল রক্তদানে সীমাবদ্ধ থাকলেও সীমাবদ্ধতার সীমারেখা অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে থাকে মানুষের বিপদে।

কথায় আর কাজে আজকাল মিল খুঁজে পাওয়া বড্ড দুষ্কর। সেখানে অনন্য ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি সংগঠনটি। কথায় ও কাজে মিল রেখে দুই বছরে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেছে অনেক দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম। আড়াই বছরে প্রায় হাজার ব্যাগের বেশি রক্তদান করেছে। ৪০টি ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে বিনা মূল্যে নির্ণয় করেছে ২০০০০ মানুষের রক্তের গ্রুপ। গত বছর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে লাকসাম উপজেলার শতাধিক স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজে একযোগে মাদকের বিরুদ্ধে গণস্বাক্ষর গ্রহণ আয়োজন সাড়া ফেলে।

নানা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’। ছবি: সংগৃহীত
নানা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’। ছবি: সংগৃহীত

গত বছরের নভেম্বরে ৪২টি মাধ্যমিক স্কুল ও মাদ্রাসার অংশগ্রহণে সাজ সাজ রবে আয়োজিত হয় ‘বিতর্ক উৎসব’। ‘প্রজেক্ট নিজভূমে নিজরূপে’ নামে প্রকল্পের আওতায় গৃহহীন দুজন বৃদ্ধ আর কয়েকজন হারিয়ে যাওয়া শিশুকে ফিরিয়ে দিয়েছে পরিবারের কাছে। পথশিশুদের জন্য শিক্ষা, অসহায় দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতবস্ত্র, ঈদবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, অভিনব সেলুন লাইব্রেরি গঠন, শহর পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি, দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ শতাধিক সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করে আসছে। ২০১৭ সালে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে প্রায় ৪০০ বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়ানো সংগঠনটি গত বছরে মানবতার দুয়ার খুলে দিয়েছে জামালপুরের ইসলামপুরে বন্যায় সর্বহারা মানুষের জন্য। আড়াই বছরে প্রায় দেড় লক্ষাধিক পরিমাণ অর্থসহায়তা তাদের মহত্ত্বের কথাই বলে। ডেঙ্গুর ভয়ানক আক্রমণে গোটা দেশ যেখানে ভীত সন্ত্রস্ত ছিল, সেখানে জনসচেতনতায় লড়ে গেছে স্বেচ্ছাসেবীরা। রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডের মতো জনবহুল জায়গায় গঠন করে হেল্প ডেস্ক, মেডিকেল টিম। দিনরাত এক করে নিজেদের সঁপে দেয় আর্তমানবতার সেবায়।

শুরুতেই নিজেদের একদিন আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে কল্পনা করার অভিলাষে গোধূলির প্রথম প্রহরে স্কুল ক্যাম্পাসের দীঘিরঘাটে আন্তর্জাতিক সংগঠন হওয়ার ইচ্ছেই যাত্রা শুরু। এরপরে ইংরেজি নামান্তরের দুঃসাহসিক গল্পের সূচনা, সেটি সময়ের ব্যবধানে ইতিমধ্যেই সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারি নিবন্ধনভুক্ত সংগঠনের স্বীকৃতি পেয়েছে। গত বছরের ২৬ জুলাই জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়ে সংগঠনের সভাপতি ফয়সাল হোসেন বাপ্পীর হাতে সনদ তুলে দেন কুমিল্লা-৯–এর সাংসদ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম। মন্ত্রী এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টাও।

পথশিশুদের জন্য শিক্ষা, অসহায়, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতবস্ত্র, ঈদবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, অভিনব সেলুন লাইব্রেরি গঠন, শহর পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’। ছবি: সংগৃহীত
পথশিশুদের জন্য শিক্ষা, অসহায়, দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ানো, শীতবস্ত্র, ঈদবস্ত্র বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, অভিনব সেলুন লাইব্রেরি গঠন, শহর পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচিসহ নানা সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে ‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি অর্গানাইজেশন’। ছবি: সংগৃহীত

সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ফয়সাল হোসেন বাপ্পী জানায়, ‘আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেতে পারব কি না জানি না, তবে আমার শহরকে সুন্দর রাখতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। রক্তের অভাবে যাতে কারও জীবন থমকে না যায়, আমরা প্রস্তুত সে জন্য। একদিন শহরের প্রত্যেক মানুষই এগিয়ে আসবে আরেকজনের প্রয়োজনে।

এ তরুণদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে প্রত্যক্ষভাবে সাহস জুগিয়ে যাচ্ছেন পৌর মেয়র অধ্যাপক আবুল খায়ের। তিনি বলেন, ‘আজকের তরুণদের হাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ব্যাটন, ওরা মেধাবী। আর দেশ ও দশের জন্য কাজে লাগলে তবেই মেধার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটবে। এদের সঠিক পথের দিশা দিতে আমি সব সময় প্রস্তুত।’

সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার আঠারো বছরের অবাধ্য কিশোরেরা যেন জেগে উঠেছে ‘ভিক্টোরি অব হিউম্যানিটি’ অর্গানাইজেশনের ব্যানারে। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ভয়, বাধা থাকলেও সবকিছুকে তুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে হবে। যেভাবে নগরপিতা আবুল খায়ের তাঁর সন্তানদের নিয়ে বলেছেন, ওরাই ভবিষ্যৎ। সেই সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যেই ওদের আজকের অনিন্দ্য অগ্রযাত্রা।