তিন দিনে ৩ লাখ ৩০ হাজার টনের অনুমতি

চাল
ফাইল ছবি

বেসরকারি খাতে কম শুল্কে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া শুরু করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। গত তিন দিনে ২৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যাকে অনেকটা তড়িঘড়ি পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। খাদ্য মন্ত্রণালয় ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত আমদানির আবেদন নেবে।

তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যেসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়েছে, সেগুলো দেশের ১২টি জেলার। এর মধ্যে নওগাঁর ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমোদন পেয়েছেন, যেটি খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নিজের জেলা। খাদ্যমন্ত্রী নিজেও একসময় চাল ব্যবসায়ী ছিলেন।

আমদানির অনুমতি দেওয়া শুরু করার প্রথম দিন, অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি ১ লাখ ৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। প্রথম দিনই নওগাঁর ব্যবসায়ীরা ৫৫ হাজার টন আমদানির অনুমতি পান। এ ছাড়া একই পরিবারের একাধিক ব্যবসায়ী চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। একজন নিজেকে খাদ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বলেও দাবি করেছেন।

দেশের বাজারে চালের দাম কমাতে সরকার আমদানিতে শুল্ক-কর ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নামানোর ঘোষণা দিয়েছে। তবে কম শুল্কে আমদানি করতে ব্যবসায়ীদের খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হচ্ছে। তাদের বেশ কিছু শর্তে অনুমোদন দিচ্ছে মন্ত্রণালয়।

২৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নওগাঁর পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ৫৫ হাজার টন, যশোরের চারটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৫ হাজার টন, সাতক্ষীরার দুটি প্রতিষ্ঠান ৪০ হাজার টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চারটি প্রতিষ্ঠান ৩৫ হাজার টন এবং বগুড়ার চারটি প্রতিষ্ঠান ৩০ হাজার চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছে। এ ছাড়া তালিকায় চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, খুলনা, গাইবান্ধা, পাবনা ও ঢাকার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

‘আমাদের পরিবার অনেক বছর ধরে চালকল পরিচালনা, চালের বিপণন ও আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানকে সরকার বেশি চাল আনার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে।’
আদিত্য মজুমদার , মেসার্স মজুমদার অ্যান্ড সন্স ও মজুমদার এন্টারপ্রাইজের মালিক

মোট চালের ৯৫ হাজার টন আমদানির অনুমতি পেয়েছেন দেশের চালকলমালিকদের মধ্যে অন্যতম মজুমদার পরিবারের দুই ভাই আদিত্য মজুমদার ও চিত্ত মজুমদার। আদিত্য মজুমদার যশোরের নওয়াপাড়া ও সাতক্ষীরার তালা উপজেলার ঠিকানায় দুই প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৫ হাজার টন আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। চিত্ত মজুমদার ঢাকার প্লানার্স টাওয়ারে অবস্থিত মজুমদার ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৫০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পান।

মেসার্স মজুমদার অ্যান্ড সন্স ও মজুমদার এন্টারপ্রাইজের মালিক আদিত্য মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পরিবার অনেক বছর ধরে চালকল পরিচালনা, চালের বিপণন ও আমদানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তাই আমাদের দুই ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানকে সরকার বেশি চাল আনার জন্য বরাদ্দ দিয়েছে।’

একই পরিবারের একাধিক ব্যক্তির অনুমতি পাওয়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে নওগাঁর ঘোষ অটোমেটিক রাইস মিলের মালিক দ্বীজেন্দ্র নাথ ঘোষের প্রতিষ্ঠান ঘোষ অটোমেটিক রাইস ও তাঁর ছেলে আকাশ চন্দ্র ঘোষের প্রতিষ্ঠান আকাশ এন্টারপ্রাইজ। এই দুই প্রতিষ্ঠান ২৫ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছে। দ্বীজেন্দ্র নাথ ঘোষ নিজেকে মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক বছর ধরে চালকলের ব্যবসা করি। তবে এর আগে মাত্র একবার চাল আমদানি করেছিলাম।’

নওগাঁর আরেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মেসার্স জগদীশ চন্দ্র রায় ১০ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। তিনি মূলত জ্বালানি তেলের ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তাঁর জ্বালানি তেল বিক্রির প্রতিষ্ঠান পারমিতা ট্রেডার্সের সঙ্গে চাল আমদানির একটি লাইসেন্সও রয়েছে। এর আগে তিনি একবার সামান্য কিছু চাল আমদানি করেছেন জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রী চাল আমদানি সুযোগ দিয়েছেন, এটা ভালো কথা। কিন্তু ২৫ শতাংশ শুল্ক আর কঠিন শর্তে চাল আমদানি করে পোষানো কঠিন।’

খাদ্যপণ্যের আমদানিকারকদের সূত্রে জানা গেছে, দেশের বেশির ভাগ বড় চাল আমদানিকারকেরা যশোরের নওয়াপাড়া ও চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জকেন্দ্রিক। এর আগে দেশে যতবার চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হয়েছে, ততবারই চট্টগ্রাম ও নওয়াপাড়ার ব্যবসায়ীরা বড় অংশ আমদানি করেছেন। তখন আমদানির ক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হতো না।

‘আমাদের মন্ত্রী চাল আমদানি সুযোগ দিয়েছেন, এটা ভালো কথা। কিন্তু ২৫ শতাংশ শুল্ক আর কঠিন শর্তে চাল আমদানি করে পোষানো কঠিন।’
জগদীশ চন্দ্র রায়, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মেসার্স

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ভারত থেকে চাল আমদানি করলে বাংলাদেশে আসার পর প্রতি কেজির দাম ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা পড়বে। অর্থাৎ দেশে চালের দামের সঙ্গে আমদানি চালের দামের পার্থক্য প্রতি কেজিতে ১৫ টাকা। ফলে যাঁরা আমদানির সুযোগ পাবেন, তাঁরা বাজারে ওই চাল বেশি মুনাফায় বিক্রি করতে পারবেন। একই সঙ্গে দেশের বাজারেও চালের দাম কমবে বলে মনে করছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।

নওগাঁর ব্যবসায়ীদের বেশি সুযোগ দেওয়া এবং কাউকে কাউকে অনেক বেশি পরিমাণে চাল আমদানির সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে জানতে খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দাবি করেন, যাঁরা আসছেন, তাঁদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কোনো জেলায় অগ্রাধিকার নেই।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শর্ত অনুযায়ী, আমদানির অনুমতি পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে হবে। পরিমাণভেদে ১০ থেকে ৩০ দিনের মধ্যে চাল আমদানি করে বাজারে ছাড়তে হবে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে অনুমোদন পাওয়া ২৯ ব্যবসায়ীর মধ্যে ১৮ জনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়। গতকাল পর্যন্ত কেউ এলসি খোলেননি বলে জানান।

২০১৮ সালে বিপুল পরিমাণে চাল আমদানি করেছেন এমন একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এত কম সময়ে ভারত ছাড়া অন্য দেশ থেকে চাল আমদানির সুযোগ নেই। আতপ চাল আমদানির সুযোগ দেওয়া হলে মিয়ানমার ও পাকিস্তান থেকে আনা যেত। তিনি বলেন, ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত আবেদনের সুযোগ আছে। সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই তড়িঘড়ি করে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে।