তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটিতেই নেই সাঁওতালদের বসবাস

কিংবদন্তির বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোলের যেসব গ্রামের সাঁওতাল আদিবাসীদের নিয়ে তেভাগা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, সেই গ্রামগুলোতে এখন সাঁওতালদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে একটি পুকুর ও একটি মন্দির আন্দোলনের স্মৃতি আজও বহন করছে।
তেভাগা আন্দোলনের ঘাঁটি ছিল নাচোলের কেন্দুয়া, ঘাসুরা, রাওতারা, চণ্ডীপুর প্রভৃতি সাঁওতাল গ্রামগুলো। এসব গ্রামে এখন কোনো আদিবাসী বসবাস করেন না। সেখানে আন্দোলনকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা তো দূরের কথা, খুঁজে পাওয়া যায় না তাঁদের উত্তরসূরিদেরও।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাওতারা গ্রামের পাশে অবস্থিত পুরোনো ওই মন্দির। মন্দিরটি ‘ইলা মিত্র মঠ’ নামেই পরিচিত। তাঁরা শুনেছেন, এই মন্দিরের পাদদেশে সংগ্রামীদের নিয়ে ইলা মিত্র সভা করতেন। আগে ওই মন্দিরে কালীপূজা হলেও আশপাশে আদিবাসী বা হিন্দুধর্মাবলম্বী না থাকায় এখন আর হয় না। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন মন্দিরটি দেখতে আসেন। নীরবে শ্রদ্ধা জানান ১৯৪৯-৫০ সালে আন্দোলনের সংগ্রামীদের প্রতি।
এ ছাড়া আন্দোলনের স্মৃতি ধরে রেখেছে রাওতারা গ্রামের আরও একটি পুকুর। আন্দোলনকারীরা পুলিশের এক দারোগা ও তিন কনস্টেবলকে হত্যার পর এই পুকুরপাড়ে পুঁতে রাখেন। পুকুরটি ‘দারোগাপুঁতা পুকুর’ নামে চেনেন স্থানীয় লোকজন। তবে পুলিশ হত্যার পর চরম খেসারত দিতে হয়েছিল আন্দোলনকারীদের। সে সময় পুলিশ আদিবাসীদের গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। ধর্ষিত হন সাঁওতাল নারীরা। প্রাণভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান আদিবাসীরা। ছত্রভঙ্গ হয়ে যান আন্দোলনের কর্মীরা।
পালাতে গিয়ে রহনপুর রেলস্টেশনে ধরা পড়েন ইলা মিত্র। ইলা মিত্রকে নাচোল থানায় নিয়ে নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ইলা মিত্রর দেওয়া নির্যাতনের জবানবন্দি ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। জবানবন্দি প্রকাশিত হওয়ার পর পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুর চেহারা উন্মোচিত হয়। সারা দেশের সচেতন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিককর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম নেয়। গত কয়েক বছর থেকে নাচোলের কেন্দুয়ায় ইলা মিত্র স্মৃতি সংসদ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে ‘জাগো নারী বহ্নিশিখা’ নামে প্রগতিশীল নারীদের একটি সংগঠন ইলা মিত্রের মৃত্যু ও জন্মবার্ষিকী পালন করছে।
প্রসঙ্গত, ইলা মিত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর এলাকার কমিউনিস্ট নেতা রমেন মিত্রের স্ত্রী। এই এলাকার শিক্ষা বিস্তারেও ভূমিকা রাখেন স্বামী-স্ত্রী। কৃষ্ণগোবিন্দপুর বালিকা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন তাঁরা। এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইলা মিত্র। রমেন মিত্র ছিলেন কৃষ্ণগোবিন্দপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা পরিষদের প্রশাসক মইন উদ্দিন মণ্ডল প্রথম আলোকে জানান, ইলা মিত্রের স্মৃতি জাগরূক থাকুক—এ উদ্দেশ্যে মন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে ইলা মিত্রের সংক্ষিপ্ত জীবনীর ফলকও লাগানো হয়েছে।