তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ডাক বিভাগের ৭১টি স্মারক ডাকটিকিট। ছবি: অ্যালবাম থেকে নেওয়া
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ নিয়ে ডাক বিভাগের ৭১টি স্মারক ডাকটিকিট। ছবি: অ্যালবাম থেকে নেওয়া

পাতা উল্টাতেই শাঁখারীবাজারের শিশু। একটি ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। আতঙ্কিত বাস্তুহারা মানুষ। তারপর রায়েরবাজারের বধ্যভূমি। গুলিতে বিদীর্ণ তরুণীর লাশ। পেছনে হাতবাঁধা বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহের স্তূপ। একে একে মিরপুরে উদ্ধার করা মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়, নির্যাতিত নারীর মৃতদেহ, বুড়িগঙ্গায় ভাসমান লাশ-পাতা থেকে পাতায় যেতে বুক বিদীর্ণ হয়ে যায়। এই পাতাগুলো বাংলাদেশ ডাক বিভাগ প্রকাশিত একটি অ্যালবামের। এতে ১৮টি স্যুভেনির শিটে ৭১টি স্মারক ডাকটিকিট স্থান পেয়েছে। স্যুভেনির শিটের পরে দেওয়া হয়েছে কবি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’। কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে পড়ল কবিগুরুর ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি...’। গানের কথাটি ঘুরিয়ে বলতে ইচ্ছা করে ‘আজি ডাক বিভাগের হৃদয় হতে ১৯৭১...।’

‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ’ শিরোনামে ডাক বিভাগ গত জুন মাসে এই বিশেষ ডাকটিকিট অ্যালবাম প্রকাশ করেছে। এ অ্যালবাম আবারও যেন বলছে, বাঙালি জাতির কাছে ‘৭১’ শুধু একটি সংখ্যা নয়, ৭১ একটি জাতির জন্মের ইতিহাস, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। সে হিসেবেই দেশি-বিদেশি আলোকচিত্রীর তোলা গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের ৭১টি বিশেষ আলোকচিত্র নিয়ে প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যমানের ৭১টি স্মারক ডাকটিকিট এবং স্মারক ডাকটিকিটের সমন্বয়ে প্রতিটি ৪০ টাকা মূল্যমানের ১৮টি বিশেষ স্যুভেনির শিট ঠাঁই পেয়েছে এই অ্যালবামে। এর সঙ্গে ১০ টাকা মূল্যমানের একটি উদ্বোধনী খাম ও ৭১ টাকা মূল্যমানের একটি বিশেষ উদ্বোধনী খাম, ১০ টাকা মূল্যমানের একটি ডেটা কার্ড ও একটি বিশেষ সিলমোহর প্রকাশ করা হয়েছে। ৭১টি স্মারক ডাকটিকিট-সংবলিত ৭১ লাখ শিট প্রকাশ করা হয়েছে। এই সবকিছুর মধ্যেই ঘুরেফিরে এসেছে আমাদের অজেয় ’৭১।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের ঘটনাসমূহকে তিন ভাগে ভাগ করেছে-গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজ-অগ্নিসংযোগ। ৭১টি ডাকটিকিট এই সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করেছে পুনর্বার যে, ১৯৭১ সালে ব্যাপক গণহত্যা হয়েছিল, ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছিলেন, ২ লক্ষাধিক মা-বোন তাঁদের সম্ভ্রম হারিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মানুষ লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের কারণে ঘরছাড়া হয়েছিল। ৭১টি ডাকটিকিট এই সত্যের সাক্ষী যে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পৃথিবীর নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছিল। 
এই ৭১টি আলোকচিত্র থেকে ৭১টি ডাকটিকিটের নকশা প্রণয়ন করেছেন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের তালিকাভুক্ত তিনজন নকশাবিদ। তাঁরা হলেন সঞ্জীব কান্তি দাস, আনোয়ার হোসেন ও বনি আদম। এই অ্যালবামে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট ও গণহত্যার বর্ণনা করা হয়েছে। একইভাবে দুই ভাষাতেই প্রতিটি ডাকটিকিটের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। 
অ্যালবামটি যে মুক্তিযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক দলিল, তা দেখানো হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্যের পরিসংখ্যান তুলে দিয়ে। তার একটিতে ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি করাচির ডন পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা নিয়োগে বৈষম্যের পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জেনারেল তিনজন, পূর্ব পাকিস্তানের একজনও নেই। মেজর জেনারেল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২০ জন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে একজনও নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের উচ্চপদের বৈষম্যে দেখা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানে সেক্রেটারি ২২ জন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে একজনও নেই। জয়েন্ট সেক্রেটারি পশ্চিম পাকিস্তানে ৪২ জন, পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র আটজন। কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পোস্টের ক্ষেত্রে দেখা যায়, অফিসার পশ্চিম পাকিস্তানে ৬৯২ জন, পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র ৪২ জন। শিক্ষাক্ষেত্রের বৈষম্যের পরিসংখ্যানে দেখানো হয়েছে মেডিকেল কলেজ পশ্চিম পাকিস্তানে ৬টি, পূর্ব পাকিস্তানে ১টি। 

ডাকটিকিটে একাত্তরের নির্মমতা
ডাকটিকিটে একাত্তরের নির্মমতা

অ্যালবামের বাণীর একাংশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘“বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ ১৯৭১” শিরোনামের স্মারক ডাকটিকিট অ্যালবামটি মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশে সংঘটিত ব্যাপক গণহত্যা, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ, শরণার্থীদের দুঃসহ জীবনের প্রামাণ্য দলিল হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই আটটি ডাকটিকিটের একটি সেট প্রকাশ করে। বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং জনমত গঠনে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া মুক্তাঞ্চলে ডাক পরিবহনেও এই ডাকটিকিট ব্যবহৃত হয়। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ডাক বিভাগ বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং জাতীয় জীবনের উল্লেখযোগ্য মুহূর্তগুলোকে ধরে রাখার জন্য স্মারক ডাকটিকিটসহ নানা স্যুভেনির প্রকাশ করে আসছে। আমি আশা করি, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ অতীত ঐতিহ্য ধরে রেখে দেশ ও জনগণের সেবায় আরও নিবেদিত হবে।’
অ্যালবামের শেষ পৃষ্ঠায় ডাক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার মণ্ডল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ এই অ্যালবাম প্রকাশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এই অংশে তিনি বলেছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনা ব্যতীত এই অ্যালবাম প্রকাশ করা হতো দুরূহ।’ একই সঙ্গে তিনি ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক মুনতাসীর মামুন, প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া প্রখ্যাত আলোকচিত্রী রশীদ তালুকদার, রঘু রাই, আনোয়ার হোসেন, এস এম শফি, রবিন সেন, কিশোর পারেখ, নায়েব উদ্দিন আহমেদ, স্যার ডোনাল্ড ম্যাককুলিন, রেমন্ড দিপারডন গামা, বেটম্যান, মেরিলিন সিলভারস্টোন, অমিয় তরফদার, আব্বাসসহ যাঁদের আলোকচিত্রের ওপর ভিত্তি করে নকশা প্রণয়ন করা হয়েছে, তিনি তাঁদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছেন।

গণহত্যার ছবিগুলো দেখে মন ভার হয়ে যায়
গণহত্যার ছবিগুলো দেখে মন ভার হয়ে যায়

নকশাবিদদের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলা, প্রাচ্যকলা ও ছাপচিত্র বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বনি আদম। তিনি ‘বাংলাদেশের চারুশিল্পে মুক্তিসংগ্রাম ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রতিফলন’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এই অ্যালবামের ডাকটিকিটের নকশা করার অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ডাকটিকিটগুলোর নকশা প্রণয়নের সময় আমার একধরনের মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছে-একদিকে যেমন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় সহযোগীদের প্রতি চরম ঘৃণার উদ্রেক করে, তেমনি পরম শ্রদ্ধায় মাথানত হয়ে আছে অমর শহীদদের প্রতি। ডাকটিকিটগুলোর নকশা প্রণয়ন করতে পারায় আমি গর্ববোধ করি।’
এই অ্যালবামের দাম রাখা হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। এর একটি কপি হাতে পেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিষয়ক গবেষক ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাশেম। তিনি বলেন, ‘ডাক বিভাগ হচ্ছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগের মাধ্যম। এই অ্যালবামের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গণহত্যার ছবি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এটি ডাক বিভাগের একটি মহতী উদ্যোগ।’