দগ্ধ ধোঁয়ার উৎকট গন্ধে পনেরো মিনিট

তৈয়েবুরের পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেল। এতেই ছিলেন তিনি। ছবি: আসাদুজ্জামান
তৈয়েবুরের পুড়ে যাওয়া মোটরসাইকেল। এতেই ছিলেন তিনি। ছবি: আসাদুজ্জামান

সকাল ১০টায় যখন চকবাজারের আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনে পৌঁছাই, তখন এলাকাটি লোকারণ্য। পুলিশ অনেক আগেই রিকশাসহ সব ধরনের যান বন্ধ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে হবু জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রী থেকে মেয়র, সাংসদ থেকে অধিদপ্তরের প্রধান সবাই এসে হাজির হয়েছেন।

চুড়িহাট্টা মসজিদ লাগোয়া কয়েকটি বাড়ি। মাঝখানে একটু খোলা জায়গা। এখন আর খোলা নেই। পুড়ে যাওয়া গাড়ির কঙ্কালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তখনো ফায়ার সার্ভিসের লোকজন পুড়ে যাওয়া ভবনের বিভিন্ন তলায় উদ্ধারকাজ করছিলেন। আগুন নিভে আসছে। কিন্তু ধোঁয়া বেরোচ্ছে ভেতর থেকে। নিচে রাস্তায় স্বেচ্ছাসেবীরা দর্শনার্থীদের সামাল দিচ্ছিলেন। দুই পাশের ভবন পুড়ে কালো হয়ে গেছে। জানালার কাচ ভাঙা। সেখান থেকে হয়তো কাউকে মৃত অথবা জীবিত বের করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ, ওষুধের দোকান, গুদাম—সবখানে ধ্বংসচিহ্ন। একজন বললেন, এই ওষুধের দোকান থেকে ছয়টি লাশ বের করা হয়েছে।

কীভাবে আগুন লাগল? আরেকজন জবাব দিলেন, গাড়ির ধাক্কা লেগে একটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। ভ্যানগাড়িটি পঁচিশ-ত্রিশ ফুট ওপরে উঠে যায়। কোথা থেকে কী হলো আমরা বুঝতে পারিনি। এরপরই কান্না, চিৎকার, অন্ধকার।

সেখানে দেখা হলো ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা ও বন্ধু মোহাম্মদ আলমগীরের সঙ্গে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ওপরে যাবেন? বললাম, যাব। এরপর তাঁর আরও দুই সহকর্মীকে নিয়ে আমাদের পুড়ে যাওয়া ভবন দেখালেন। আশপাশের আরও তিন-চারটি ভবন পুড়লেও এটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। আরও কয়েকজন সংবাদকর্মী আমাদের পেছন পেছন ওপরে উঠলেন। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে দেখি সর্বত্র স্প্রের পোড়া কৌটা। প্লাস্টিকের জঞ্জাল। নিচ থেকে ওপরে পানির পাইপ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিঁড়িতে, মেঝেতে পোড়া বস্তু ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। আগুন নেভানোর জন্য পানি দেওয়ায় মেঝে-সিঁড়ি থকথকে হয়ে পড়েছে। যেখানে পা রাখি পুড়ে যাওয়া জঞ্জাল। তিনতলায় উঠতেই ধাক্কা খেলাম। ভেতরে তখনো আগুনে পোড়া গ্যাসের উৎকট গন্ধ।

আলমগীর বললেন, আপনার কাছে রুমাল থাকলে নাকে দিন। আমরা তো অভ্যস্ত। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই আমাদের শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছিল। দম বন্ধ অবস্থা। আমরা মিনিট পনেরো পর নিচে নেমে এলাম।

তিনতলায় দেখলাম, বসত ও গুদামঘর পাশাপাশি। এক পাশে মানুষ বাস করছিল। তাদের পুড়ে যাওয়া আসবাব, চেয়ার-টেবিল। থালাবাসন পড়ে আছে। শুধু মানুষগুলো নেই। আরেক পাশে গুদামের দগ্ধ মালামাল। ভেতরে অন্ধকার, ভুতুড়ে অবস্থা।

নিমতলী থেকে যাত্রাবাড়ী। যাত্রাবাড়ী থেকে চকবাজার। আমাদের আর কত মৃত্যু দেখতে হবে? আর কত ধ্বংস প্রত্যক্ষ করতে হবে? আর কত লাশ গুনতে হবে? বিত্তবানদের লোভ ও প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা বারবার সাধারণ মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। মৃত্যুর পর সবাই সংখ্যা হয়ে যায়। আমরা সংখ্যা গুনি। কিন্তু মৃত্যু ঠেকাতে পারি না।

আমরা যখন নিচে নেমে এলাম, তখন দেখি চারদিক থেকে আরও লোকজন আসছে। মৃত ও নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনেরা আহাজারি করছেন।

তখন খবর পাওয়া গেল, দুর্ঘটনাস্থল দেখতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এসেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান এসেছেন। স্থানীয় সাংসদ হাজি সেলিম এসেছেন। রাতে এসেছিলেন দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন। আরও সরকারি কর্মকর্তা এসেছেন।

তাঁদের আসার খবর শুনে পাশ থেকে একজন বললেন, ‘আমাদের নেতারা দুর্ঘটনা ঘটার পর আসেন। মানুষ মারা যাওয়ার পর আসেন। সান্ত্বনা দেন। আশ্বাস দেন। কিন্তু দুর্ঘটনা বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নেন না।’

ফেরার পথে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক শাকিল আহমেদের সঙ্গে কথা হলো। জিজ্ঞেস করলাম এই যে মহাবিপর্যয় ঘটল এর প্রতিকার কী। তিনি বললেন, ‘আমরা যদি সবাই সজাগ হতাম তাহলে দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। বললেন, এখানে সড়ক এতই সরু যে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারে না। এলাকায় পানির ব্যবস্থা নেই।’

পাশ থেকে একজন বললেন, আশপাশে পানি না পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ড্রেনের পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে।

আরও পড়ুন: