দরকার শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি

প্রাথমিক শিক্ষার সব কর্মকাল কেন শুধু ঢাকার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পরিচালিত হবে? করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে বিকেন্দ্রীকরণ কত প্রয়োজন।

একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হতে লাইনে দাঁড়িয়েছে শিক্ষার্থীরা।ছবি: সাজিদ হোসেন

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বহুদিন ধরে নানা ধারা-উপধারায় বিভক্ত। সবকিছু মিলিয়ে বর্তমানে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে দেশের মোট জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশের বর্তমান থমকে গেছে, ভবিষ্যৎও ঝুঁকিতে রয়েছে। পৃথিবীব্যাপীই এই সমস্যা চলছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের পাশাপাশি শিক্ষাক্ষেত্রেও বড় ধরনের আঘাত এসেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘শিক্ষার যে সংকট চলমান ছিল, সেটি এখন মহাদুর্যোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে।’ এই দুর্যোগের অনেক কিছুই এখন বাংলাদেশেও দৃশ্যমান।

প্রাক্-প্রাথমিক থেকেই যদি শুরু করি, তাহলে দেখব করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে এই স্তরের তেমন কোনো কর্মকাণ্ড এখন চলমান নেই। মানবসন্তানের প্রারম্ভিক বিকাশ ও প্রাথমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করার কারণে প্রাক্-প্রাথমিকের গুরুত্ব এখন সারা বিশ্বেই স্বীকৃত। কিন্তু করোনার সময়ে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা থমকে যাওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সংক্রমণ বিবেচনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করা ছাড়া বিকল্পও ছিল না। তাই প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রধানত যে চারটি মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় সক্রিয় রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হলো টেলিভিশন, অনলাইন, বেতার ও মুঠোফোন। অনির্ধারিত বন্ধ আমাদের ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচিত ও অভ্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে, এটা যেমন ঠিক, তেমনি কঠিন বাস্তবতা হলো, এই দুয়ার সবার জন্য খোলা এখনো সম্ভব হয়নি। সেখানেই দুর্ভাবনা, সেখানেই দুর্যোগের ঘনঘটা।

করোনার সময়ে প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা থমকে যাওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত চারটি বড় ধরনের সংকটের পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে। প্রথমত, করোনার কারণে বড়সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। অথচ ঝরে পড়া কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিরাট সফলতা ছিল। প্রাথমিকে ২০০৯ সালেও ঝরে পড়ার যে হার ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ, সেটি প্রায় ১৮ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। নিরবচ্ছিন্নভাবে চললে এই ১৮ শতাংশকে আরও লাগামের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হতো, কিন্তু সেটি এখন বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। দ্বিতীয়ত, ছেলেমেয়ে সবার ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা মাঠে-ময়দানে দেখতে পাচ্ছি, আয়–নিরাপত্তা ও খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ার কারণে বিরাট জনগোষ্ঠী বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানদের শিক্ষার বদলে শিশুশ্রমে নিযুক্ত করছে। এই শিশুশ্রমও কিন্তু অনেকখানি আমাদের লাগামের মধ্যে চলে এসেছিল। করোনার প্রভাবে সেটি আবার লাগামহীন হয়ে যেতে পারে। তৃতীয়ত, বাল্যবিবাহের হার বাড়তে পারে। এমনিতে বাংলাদেশ বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে ঝুঁকিপ্রবণ একটি দেশ। এটির লাগাম কিছুটা হলেও টেনে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি বাঁধভাঙা স্রোতের মতো ভেসে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ছাত্রীরাই বেশি ঝুঁকিতে আছে।

রাশেদা কে চৌধূরী

চতুর্থত, অপুষ্টি আরও বাড়তে পারে। এ বিষয়ে আগে থেকেই বাংলাদেশ ঝুঁকিতে ছিল। অপুষ্টির হারের দিক দিয়ে ২০১৮ সালের হিসেবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। খাদ্যনিরাপত্তা ও আয়–নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকার কারণে সেই হার বেড়ে যেতে পারে। তবে আশার কথা, এই যে বাংলাদেশের অর্থনীতি মোটামুটি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কৃষি, শিল্পকারখানা ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা—এই তিন জায়গায় হোঁচট খেলেও যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারি, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তার সংকট কিছুটা কাটতে পারে এবং অপুষ্টির ঝুঁকিও হ্রাস পেতে পারে।

তদুপরি, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের আগে থেকেই সর্বস্তরে শিক্ষার মান নিয়ে নীতিনির্ধারকসহ সবার মধ্যে উদ্বেগ ছিল। এখন শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠনের বদলে বিকল্প পদ্ধতিতে যেভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, তাতে সংখ্যাগত দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া এবং মানের দিক দিয়ে আরও পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংসদ টিভি বা অন্যান্য মাধ্যমে সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে পৌঁছানো এখনো সম্ভব হয়নি। তদুপরি, যারা এসব মাধ্যমে যুক্ত হতে পারছে, সেখানে তাদের শ্রেণিকক্ষের মতো মিথস্ক্রিয়া হয় না, শিক্ষককে প্রশ্ন করার সুযোগ তারা পায় না। মিথস্ক্রিয়া হচ্ছে না বলে মানের বিষয়টিও পরিমাপ করা যাচ্ছে না। আর যারা এসব সুবিধার বাইরে রয়ে গেছে, তাদের কি সংখ্যাগত কি মান—কোনোটাই জানা সম্ভব হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাপীই একধরনের ধস নামার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

আমাদের দেশে মূল্যায়ন হয় শ্রেণিকক্ষে, বিদ্যালয়ের পরীক্ষায় এবং জাতীয় কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু করোনার কারণে সব ধরনের মূল্যায়ন ও পরীক্ষা থমকে গেছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলো বাতিল করতে হয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এখন অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। যদিও এই সুযোগে ‘নতুন স্বাভাবিক’ পর্যায়ে করোনা–পরবর্তী সময়ে ‘পরীক্ষানির্ভর, সনদসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থা’ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়াস নেওয়া উচিত হবে।

আমরা আশা করছি, একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবেই। সেখানে বড় দুটি বিষয় আছে। একটি হলো নতুন স্বাভাবিকতার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতির কারণে অতি সহজে মানসম্মত শিক্ষাদান করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু যখন খুলবে, তখন ভৌত অবকাঠামো ঠিক আছে কি না, স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো সুযোগ-সুবিধা আছে কি না, সেগুলো প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠবে। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার বড় অনুষঙ্গ হলো শিক্ষক, তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করতে হবে। কারণ, ভবিষ্যতে হয়তো সশরীরের পাশাপাশি অনলাইনে পড়াশোনার মিশ্র ব্যবস্থা রাখতে হবে। এসব কাজের জন্য বড় ধরনের প্রস্তুতি দরকার। অনেক দেশ ইতিমধ্যে নানাভাবে এসব কাজ শুরু করেছে। আমাদের দেশে চার কোটি শিক্ষার্থীর জন্য সব ধরনের প্রস্তুতিকাজ অবশ্য ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু এগুলো করতেই হবে। এসবের জন্য সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও গড়ে তুলতে হবে। এখানেই মনে হয় আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। না হলে কাঁচাবাজারেও কেন মানুষ মাস্ক পরতে চায় না। আমার ধারণা, সর্বস্তরের জনগণ আরও সচেতন হলে বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি এত দিনে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল, কিন্তু সেটি হয়নি। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে সঠিক বার্তা পৌঁছে দিতে হবে।

করোনার কারণে প্রায় একটি শিক্ষাবর্ষ শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনা ছাড়াই শেষ হতে যাচ্ছে। এই সময়ে নানা মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হলেও শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে গেলে আমাদের তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। একটি হলো, যারা এসব মাধ্যমে যুক্ত হচ্ছে, তারা কতটুকু শিখনফল অর্জন করতে পারছে, সেটি বিবেচনায় নিয়ে কাজ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেসব শিক্ষার্থী কোনো মাধ্যমেই যুক্ত হতে পারেনি, তাদের ক্ষতি পোষানোর ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। এসব শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে আস্থা আনতে হবে। আর এ জন্য প্রথমে দরকার সঠিক তথ্য-উপাত্ত জানা। কিন্তু এই মুহূর্তে কতজনের কাছে শিক্ষার বিকল্প সুযোগ পৌঁছানো গেছে, তার সঠিক কোনো তথ্য জানা নেই।

আমি মনে করি, পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাধ্যমে আদমশুমারির মতো ‘শিক্ষাশুমারি’ অনতিবিলম্বে হওয়া দরকার। দ্বিতীয়ত, তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সবার জন্য একই ধরনের ব্যবস্থা না নিয়ে প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, করোনার কারণে অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে যেতে বসেছে। যুব ও বয়স্ক ব্যক্তিদের সাক্ষরতা অর্জনের কর্মসূচিও পিছিয়ে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক দূরে সরে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

কীভাবে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে সব উন্নয়নশীল দেশই হিমশিম খাচ্ছে। এটি আমাদের জন্যও বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাই এ বিষয়ে যথাযথ পরিকল্পনা করে ‘শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি’ হাতে নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সশরীর শিক্ষার পাশাপাশি পরিপূরক হিসেবে টিভি, বেতার বা অনলাইনের মাধ্যমে পড়াশোনার মিশ্র ব্যবস্থা রাখতে হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ডিভাইস ও ডেটা সহজলভ্য করতে হবে।

আমাদের এখানে বিভিন্ন খাতের জন্য পরিকল্পনা হয়, বিনিয়োগ হয়, কিন্তু যথাযথ তদারকির অভাবে মাঝপথেই অনেক লুটপাট হয়ে যায়। তাই নিবিড় তদারকি করা অতিজরুরি। বিশেষ করে ক্রয়ব্যবস্থা যেন টেন্ডারবাজির কবলে না পড়ে, সেটি দেখতে হবে। স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে। তদুপরি, সব কাজের বিকেন্দ্রীকরণ হওয়া দরকার। প্রাথমিক শিক্ষার সব কর্মকাল কেন শুধু ঢাকার প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে পরিচালিত হবে? করোনা মহামারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে যে বিকেন্দ্রীকরণ কত প্রয়োজন।

তবে পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও তদারকি; যা–ই বলি না কেন, সর্বাগ্রে প্রয়োজন পর্যাপ্ত বিনিয়োগ এবং এর যথাযথ ব্যবহারের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে প্রণোদনা প্যাকেজও দিতে পারে সরকার। চলতি অর্থবছরের অনেকখানি সময় চলে গেছে। শিক্ষা বাজেটের অনেক টাকা এখনো অব্যয়িত রয়ে গেছে। সেখান থেকেও সংশোধিত বাজেট প্রণয়ন করে ‘শিক্ষা পুনরুদ্ধার কর্মসূচি’তে কাজে লাগানো সম্ভব। আমাদের সবার একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার, সেটি হলো শিক্ষার ক্ষতি পোষাতেই হবে, শিক্ষাকে শুধু মানবাধিকার হিসেবেই নয়, উন্নয়নের অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে।


রাশেদা কে চৌধূরী: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা