দাম্পত্য

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

লাইফ সাপোর্টে অল্প কয়েকদিন থাকার পরই মারা গেল গোলাম আসলাম।

করোনায় জীবন নাশ। করোনা শেষ হয়ে চলে যাওয়ার সময় এ রকমের সর্বনাশ।

পুরো ঘটনাটা ঘটতে লাগল মাত্র কয়েকটা দিনে। চোখের নিমেষে যেন সব ঘটে গেল। বুক চাপড়ে কাঁদল আফসানা। ২৩ বছরের সংসার তাঁর। ছেলেটির বয়স মাত্র ১৯। তার ওপর ছেলেটি কানাডায় মাত্র মাসখানেক আগে পড়তে গেছে।

আর আসলাম তো যে সে স্বামী ছিল না। আফসানা ছিল আসলামের জীবনের সব। আফসানার সামান্য কিছু হলেই আসলাম যেন পাগল হয়ে যেত। দেশ–বিদেশ তুলকালাম করে ফেলত।

কেউ এসব নিয়ে হাসিঠাট্টা করলে আসলাম বলত, আরে, বলো কী, রানি (আফসানার ডাক নাম) আমার জীবনে না এলে এতদিন আমি রাস্তায় ফেরি করে বেড়াতাম! কেরানি বাবার ছেলে আমি, এতসব বিষয়–আশয় আমার জীবনে হতো কি? রানি আমার জীবনে এসেছে বলেই না আজ আমার জীবনে এতসব রমরমা, দহরম মহরম।

কথাটা হেসে হেসে বললেও মানুষ জানে এটা সত্যি।

নইলে সত্যি বলতে আসলামকে ঢাকা শহরে আগে চিনত কে? তার ব্যাকগ্রাউন্ড কি? কিছুই না। ঢাকা ভার্সিটির পলিটিক্যাল সায়েন্সে পড়াশোনা করা ছেলে। লেখাপড়ায় আহামরি এমন কিছু না। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়তে পড়তেই প্রেম হয়ে গেল আফসানার সঙ্গে। আসলামের একটা গুণ ছিল। খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারত। অনর্গল কবিতা মুখস্থ বলতে পারত। মেয়েদের মন রেখে বানিয়ে বানিয়ে অনেক গল্প করতে পারত। একসময় আফসানা কীভাবে যেন তাকে ভালোবেসে ফেলল। আর আসলামও তার প্রতিদান দিতে দেরি করল না।

আফসানা বড়লোকের কন্যা। বাপ–মায়ের আদুরে মেয়ে, যদিও তার আরও দুটো বোন আছে, কিন্তু তারা তার ছোট।

আসলামের বড় গুণ ছিল সে পরিশ্রমী। আর বুদ্ধিমান। চট করে ব্যবসার ঘোরপ্যাঁচ বুঝে যেত। আফসানার বাবা প্রথমে তো আসলামের সঙ্গে আফসানাকে বিয়ে দিতে চাননি। আসলামের সঙ্গে প্রথম দিন কথা বলেই তিনি মেয়েকে বলেছিলেন, আফসা, এই ছেলেটিকে আমার কেন যেন বুদ্ধিমানের চেয়েও বেশি চতুর বলে মনে হয়।

আর বাবার কথা শুনে মনে মনে রাগ করেছিল আফসানা। সে মনে মনে বলেছিল, বাবা, আসলাম আর যা কিছু হোক, চতুর নয়।

তারপর কত বছর চলে গেছে। একের পর এক ধাপ পার হয়ে ওপরে উঠেছে আসলাম।

প্রেমের প্রথম পর্যায়েই আফসানা আসলামকে একটা শর্ত জুড়ে দিল—দেখ, আসু, তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি কিন্তু কোনো মেয়ের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতে পারবে না, আমি এগুলো অপছন্দ করি।

আসলাম হেসে বলল, আর কি অপছন্দ করো?

একটু ভেবে আফসানা বলল, আর আগ বাড়িয়ে কারও কোনো কাজ করতে যেয়ো না। এতে মানুষ মনে করে তোমার কোনো উদ্দেশ্য আছে।

আসলাম বলল, তথাস্তু।

এত সহজে আসলাম সব কথা মেনে নিল বলে আফসানার মনে কেমন যেন একটু গ্লানি হলো।

সে বলল, তুমি কি আমার কথা শুনে রাগ করলে?

আসলাম হেসে আফসানার গাল টিপে দিয়ে বলল, আমি তোমাকে ছাড়া আর কিছু বুঝি না। তুমি ছাড়া আর সব কিছুই আমার কাছে গৌণ।

তো এভাবে সব ঠিক ছিল। সুন্দর একটা দাম্পত্যজীবন গড়ে তুলল দুজনে। ছেলে হলো। আসলামের ব্যবসা বড় হলো। দেশ–বিদেশ করতে লাগল আসলাম। প্রথম প্রথম বিদেশ গেলে আফসানাকে সঙ্গে নিয়ে যেত। আর আফসানাও খুশি মনে যেত স্বামীর সঙ্গে। কিছুদিন এভাবে চলার পর সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আফসানা। তখন তার কত কাজ! বাইরের চাকরি ততদিনে সে ছেড়ে দিয়েছে। তা ছাড়া অত চাকরির দরকারও তো নেই। ছেলে–স্বামী–সংসার নিয়ে তখন তার জমজমাট অবস্থা। বিদেশ গেলে অল্প কদিন পরেই আফসানা দেশে ফেরার জন্য আস্থির হয়ে উঠত।

একসময় সে আর অত বেশি বাইরে যেত না। সে বাইরে না গেলে কি হয়? যতবার আসলাম বিদেশ যেত, বাক্স ভর্তি করে উপহার নিয়ে আসত স্ত্রীর জন্য। সেই সব উপহার আফসানা বোনদের বিলিয়ে দিত। আর বোনেরা মুখ সরু করে বলত, ইশ, দুলাভাই, মনে করে তুমি বুঝি এখনো সেই তরুণী আছ। নইলে এ রকম কানের দুল? এ রকমের ড্রেস? এসব শুনে আফসানার মুখে একটাই কথা ফুটত, কেন, তোদের হিংসে হয় বুঝি?

সেই আসলাম, তার প্রিয়তম স্বামী, করেনানায় মাত্র ১০ দিনের মধ্যে মারা গেল। মৃত্যু যে কী—তা বোঝার অগেই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল আসলাম। এতগুলো ইনজেকশন নেওয়ার পরেও মারা গেল। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? হ্যাঁ, তার একটু ব্লাড প্রেশার ছিল, হার্টে দুটো রিং পরানো ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও সে ছিল সুস্থ সবল সাবলীল একজন মানুষ।

সেই মানুষের মৃত্যুর পর তার মুখটাও ভালো করে দেখতে পেল না আফসানা। তড়িঘড়ি করে কবর দেওয়া হলো তাকে। এই পুরো কাজটা সম্পন্ন করল একটা জনহিতকর সংস্থা। যাদের কাজ হচ্ছে করোনা রোগীর দাফন।

এরপর আফসানার হঠাৎ একাকী জীবন। না ছেলে আমেরিকা থেকে আসতে পারেনি। তার সেমিস্টার সবেমাত্র শুরু হয়েছে। ছেলে শুধু হাউমাউ করে কেঁদেছে। বাবার লাশ দেখেছে হোয়াটসঅ্যাপে। পুরোটা সময় ধরে দেখেছে এবং পাগলের মতো কেঁদেছে। পৃথিবীজুড়ে এখন তো কান্নারই মরসুম চলছে।

স্বামী মারা যাবার মাস তিনেক পর নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে আফসানা বিছানা ছেড়ে উঠল। এই কয়েকটা মাস সে যেন একটা ঘোরের ভেতরে ছিল। ঘোর বটে, কিন্তু অনর্গল অশ্রুর কোনো ব্যারিকেড ছিল না। তারা মুখ বেয়ে, বুক বেয়ে পড়তে লাগল অনর্গল। বোনেরা যথসম্ভব তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। কিন্তু তাতে কি আর হয়। আফসানার মনে হতে লাগল হঠাৎ করে যেন জীবনযুদ্ধে হেরে গেছে সে। আসলামকে নিয়ে তার আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। এ সময় তাকে শারীরিকভাবে অফিসিয়াল মিটিংয়ে যেতে দেওয়া তার উচিত হয়নি, ভার্চু৵য়াল মিটিংয়ে আটকে রাখাই কর্তব্য ছিল। কিন্তু আর কতদিন? দেড় বছরের বেশি হতে চলল এই করোনার প্রকোপ। মানুষের সব ধ্যান, ধারণা, স্বপ্ন বানচাল করে দিয়েছে এই ভাইরাস। আর কতদিন মানুষ তার থাবার মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখবে?

তা ছাড়া পরিস্থিতি তো একটু স্বাভাবিক হয়ে আসছিল দিনে দিনে। দিনে ১০–১২ জনের মৃত্যুর ভেতরে সংখ্যা সীমিত হয়ে এসেছিল। কারোনা প্রতিরোধের দুটো ইনজেকশনও নেওয়া হয়েছিল। তৃতীয়টির জন্য অপেক্ষা চলছিল মনে মনে। আসলাম মারা যাওয়ার ১৫ দিন পরেই তার তৃতীয় ডোজ নেওয়ার ডাক পড়েছিল। বিন্তু হায়! ততদিনে আসলাম কোথায়!

পহেলা বৈশাখে নিজেকে গুছিয়ে তুলতে চেষ্টা করল আফসানা। নতুন বছর এসে গেছে। শোক সামলে আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। কারণ তাদের ছেলেটি এখনো ঠিকঠাক দাঁড়াতে পারেনি। তার লেখাপড়া এখনো শেষ হয়নি। আফসানা তার ঘরের মেঝেয় বসে স্বামীর জামাকাপড়, প্যান্ট, জুতো, কাগজপত্র—একটার পর একটা ব্যাগ গোছাতে লাগল। চোখের পানি মুছতে মুছতে গোছাতে লাগল। চোখ থেকে পানি তার সরছেই না। তাকে পাহারা দিয়ে বসে থাকল ছোটবোন ফারজানা। এই বোনটি তার ন্যাওটা। বিয়ে হয়েছে, কিন্তু মনে মনে একটি দুঃখ পুষে রেখেছে আজীবন—কোনো সন্তান হয়নি তার। সমস্যা ওর স্বামীরই। কিন্তু স্বামীকে সে ভালোবাসে, তাই তাকে ছেড়ে যায়নি। কিন্তু নীরব হাহাকারের একটি মলিন রেখা তার কপালজুড়ে গাঢ় হয়ে থাকে রাতদিন।

ফারজানা বসে ছিল আফসানার ঘরের মেঝেয়। বসার ঘরে টেলিভিশন খুলে রেখেছিল সে। এই বিশাল নির্জন ফ্ল্যাটের মরা আবহাওয়াকে সামান্য জীবন্ত করে রাখার খানিকটা চেষ্টা যেন। টেলিভিশনে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা বের করবার জন্য চারুকলার তোড়জোড়ের সচিত্র খবর। বছর দুই পরে আবারও বৈশাখী শোভাযাত্রা। পর্দায় দেখা যাচ্ছিল মুখ ব্যাদান করা কাগুজে বাঘ, পেখম েতালা ময়ূর, রাজকীয় কেশর ঝুলানো সিংহ আর বাজপাখির দাপট। যেন দেশের সব অশুভের বিরুদ্ধে শুরু হয়ে গেছে তাদের লড়াই। ঝলমলে সাজসজ্জায় তারা এখন রাস্তায় নেমে আসবার জন্য প্রস্তুত।

আফসানা ঘরের মেঝেয় পা গুটিয়ে বসে স্বামীর একটা প্যান্টের পকেটে হাতড়িয়ে বের করে আনল একাধিক রুমাল। রুমালগুলো বাজার থেকে কেনা। দামি কোম্পানির। তার ভেতরে দেখতে পেল হাতের কাজ করা একটা রুমাল। সাদা রঙের। আর এক কোনায় সুন্দর করে নীল সেলাইয়ের বাঁকানো অক্ষরে লেখা নাম—রোজানা। খুব ছোট্ট করে নামটি লেখা। এত ছোট্ট যে প্রথম দৃষ্টিতে সেটা একটা ডিজাইন বলে ভ্রম হয়। আফসানা কোনোদিনই আসলামের মুখে এই নাম শোনেনি। আসলামের একটা ছোটবোন আছে—বিলকিস। বিয়ে হয়েছে অনেককাল। রাজশাহীতে থাকে। ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে খুব কান্নাকাটি করেছে। কিন্তু আসতে পারেনি। কারণ, সে সময় তার ছোট ছেলেরও করোনা হয়েছিল। এ রুমাল তো বিলকিসেরও দেওয়া নয়। তাহলে?

অশ্রুপ্লাবিত চোখে কিছুক্ষণ রুমালের দিকে তাকিয়ে থাকল আফসানা। তারপর কী মনে করে আবার গোছাতে শুরু করল। তার স্বামী ছিল নামকরা ব্যবসায়ী। কত মানুষের সঙ্গে তার কারবার! তাকে কত কি উপহার দিয়েছে কতজন, সেসব তো আফসানার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানা সম্ভব নয়। আর বিশেষ কোনো মানুষ হলে আফসানা সেটা জানত। আসলাম কখনো লুকোছাপার মানুষ ছিল না—এ বিশ্বাস তার বরাবরই ছিল।

এবার সে হাতে নিল স্বামীর মোবাইল ফোন। আসলামের কাছে পাঁচটা মোবাইল ফোন। দুটো দামি আর তিনটে সাধারণ। ব্যস্ত ব্যসায়ীদের এ রকম অনেক মোবাইল ফোন থাকে। আফসানার নিজেরই তো তিনটে। একটা মোবাইল ফোন শুধু তার বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করবার জন্য।

স্বামীর প্রতিটি মোবাইল ফোন একবার করে খুলে আফসানা তার নিজের চেহারা দেখল। অন করতেই পর্দায় তার চেহারা। তবে প্রতিটি ছবির পোজ আলাদা। ভঙ্গিও আলাদা। বুঝল আসলাম বিভিন্ন ভঙ্গিতে তার স্ত্রীকে তাকিয়ে দেখতে ভালোবাসত। একটি ছবিতে আফসানা বিদেশি স্কার্ট আর ঝোলা জামা পরে দাঁড়িয়ে আছে। আসলামের মোবাইলের পর্দায় যে তার ছবি থাকে—এটা আফসানা জানত। একইভাবে তার মোবাইল ফোনের পর্দায়ও আছে আসলামের ছবি। তবে শুধু আসলাম নয়, নিজের ছেলের ছবিও জড়িয়ে আছে ওই একই ছবিতে। ছেলে আর স্বামী মিলেই তো আফসানার নিজস্ব পৃথিবী।

শেষ একটা মোবাইল ফোন শুধু দেখা গেল, আসলাম কোট–টাই পরে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পেছনে একটা বিশাল প্যাগোডার ছবি। সাদা থাক থাক হয়ে ঈশ্বরের মহিমায় ক্রমাগত ওপরে উঠে গেছে। খুব সম্ভব ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে তোলা। ওই ছবি দেখে আবারও চোখ টলটল করে উঠল আফসানার। আহা, তার হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া স্বামী, তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ফিঁয়াসে। কী সুন্দর করেই না সে হাসছে!

কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে দেখল সে। আনমনে চেয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর কী ভেবে মোবাইল ফোনের পর্দায় থাকা ফেসবুকে চাপ দিল। ঠিক সে সময় চার হাজার স্কয়ার ফুটের এই ছয়তলার ফ্ল্যাটের বাইরে কার্নিশে বসে ডানা ঝাপটিয়ে ভাঙা গলায় চিৎকার করে ডেকে উঠল একটা কাক।

যেন একটা ম্যাজিক ঘটে গেল মুহূর্তেই। আফসানার চোখের সামনে যেন হঠাৎ করে বেরিয়ে এল অন্য কিছু। এমন কিছু, এমন অচেনা কিছু—ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যানিমেটেড, অবাক হয়ে গেল আফসানা! দ্রুততার সঙ্গে তার চোখের পানি লাগল শুকাতে। এর বদলে সেখানে জমতে লাগল রক্ত। মুখ হা হয়ে গেল। চোয়াল গেল ঝুলে। পায়ের নিচ থেকে যেন দ্রুত সরতে লাগল মেঝে। আফসানা চিৎকার করে উঠতে গেল। খুব জোরে চিৎকার করে উঠতে গেল। কিন্তু তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। যা বেরোল তাকে কিছু অব্যয় ধ্বনি বলা যেতে পারে।

এদিকে সিটিংরুমের টেলিভিশনের পর্দায় ঝলমল করতে করতে শিঙ্গা ফুঁকে বাংলার যাবতীয় জীবজন্তু নিয়ে আলপনা আঁকা রাজপথজুড়ে বেরিয়ে এল চারুকলার সব ছাত্রছাত্রী। পৃথিবীর সব অশুভের বিরুদ্ধে চারুকলার অভিযান। শাশ্বত অভিযান।