দারিদ্র্য ছাপিয়ে তাক লাগানো সাফল্য

>কেউ দিনমজুর, গৃহকর্মীর কাজ করেছে। কেউবা গোবর কুড়িয়ে বিক্রি করেছে। কেউ নিজে কোচিংয়ে না পড়ে উল্টো অন্যদের পড়িয়েছে। যে কাজই করুক, সঙ্গে ছিল শুধু বড় হওয়ার অদম্য ইচ্ছা। সেই ইচ্ছা পুষে রাখতে জীবনসংগ্রামের কঠিন সব পথ বেছে নিতে হয়েছে তাদের। দারিদ্র্যের নির্মম বাস্তবতার মধ্যে পড়াশোনা চালিয়ে সফল হয়েছে এসএসসি পরীক্ষায়। জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সারা দেশের আনাচে-কানাচে থাকা এসব অদম্য মেধাবী। আজ প্রথম পর্বে আট শিক্ষার্থীর সাফল্যের গল্প প্রকাশিত হলো।
শরিফা খাতুন
শরিফা খাতুন

গৃহকর্মীর কাজ করেছে শরিফা
ভূমিহীন দিনমজুর সফিকুল ইসলাম। আগ্রহ থাকলেও মেয়ে শরিফা খাতুনকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ্য ছিল না। তবে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় ভাগ্য খোলে তার। জেএসসি পরীক্ষাতেও বৃত্তি পায় সে। কিন্তু নবম শ্রেণিতে ওঠার পর পড়ালেখার খরচ বেড়ে যায়। মেয়েকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সফিকুল। কিন্তু শরিফার ইচ্ছা অনেক দূর এগোনোর। শেষ পর্যন্ত সে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে পড়ালেখা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।

মেয়ের ইচ্ছাশক্তির কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানেন সফিকুল। প্রতিবেশী তিনটি বাড়িতে সকাল-বিকেল পালা করে কাজ শুরু করে শরিফা। এভাবে লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

পরিবারটির বসবাস সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের খড়িতলা গ্রামে। শরিফা স্থানীয় উজ্জীবনী ইনস্টিটিউট থেকে মানবিক বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। তার স্বপ্ন একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার।

বাবা সফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সকাল-বিকাল কাজ করে রাতে শরিফা যখন বই নিয়ে বসত, তখন মেয়েটার দিকি তাকানো যেত না। আমরা গরিব মানুষ। ২ শতক ভিটেবাড়ি ছাড়া কিছু নেই। তাই পড়ালেখা করাতি শরিফাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ পর্যন্ত করতি হয়েছে।’

কালীগঞ্জ উজ্জীবনী ইনস্টিটিউটের প্রধান শিক্ষক শেখ ইকবাল আলম বলেন, ‘শরিফা লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো। ওর ইচ্ছাশক্তি প্রবল। ও পারবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে। এ জন্য চাই একটু সহযোগিতা।’

ইসমাইল হোসেন
ইসমাইল হোসেন

বন্ধুরা যেত খেলতে, ইসমাইল টিউশনিতে
অসুস্থ হয়ে বাবার দুই পা কেটে ফেলতে হয়েছে পাঁচ বছর আগে। সংসারে উপার্জন করার মতো আর কেউ নেই। তাই স্কুলে ছুটির ঘণ্টা বাজতেই অন্যরা যেখানে বাড়ি ফিরে খেলাধুলায় মগ্ন হয়ে যেত, সেখানে ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়াকে নামতে হতো ভিন্ন পথে। বইখাতা গুছিয়ে রেখে কয়েকটি বাড়িতে গিয়ে টিউশনি করেছে সে। বাচ্চা পড়িয়ে রাতে বাড়ি ফিরে তবেই নিজের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে পেরেছে।

এ রকম নানা সংকটের মধ্যে থেকেও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে ইসমাইল। সে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার চিনামুড়া এলএন উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। হার না মানা ছেলেটির বাড়ি উপজেলার বায়নগর গ্রামে। ভবিষ্যতে চিকিৎসক হতে চায় ইসমাইল।

ইসমাইলের মা শাহানারা বেগম বলেন, অভাবের সংসার। ছেলের জন্য কখনোই ভালো পোশাক কিনে দিতে পারেননি তিনি। ভালোমন্দ দূরের কথা, ছেলের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাতই তুলে দিতে পারেননি। তবু ইসমাইল ভালো ফল করেছে। এখন তাকে কলেজে ভর্তির টাকা কোথায় পাবেন, সেই দুশ্চিন্তায় ঘুম আসে না।

চিনামুড়া এলএন উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মনির হোসেন বলেন, ‘ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়া লেখাপড়ায় খুবই ভালো। বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে আমরা যতটুকু সম্ভব সহায়তা করেছি। কিন্তু কলেজে পড়তে হলে, বড় স্বপ্ন পূরণ করতে হলে যেতে হবে অনেক পথ। হতদরিদ্র পরিবারটির সেই সামর্থ্য নেই।’ কেউ পাশে দাঁড়ালে ছেলেটি ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে বলে তাঁর বিশ্বাস।

মাধবী রাণী
মাধবী রাণী

গোবর কুড়িয়ে বিক্রি করেছে মাধবী
মাধবী রানী মাঠ-ঘাট থেকে গোবর কুড়িয়েছে। তা রোদে শুকিয়ে প্রতি ডালি বিক্রি করেছে ২০ টাকায়। এভাবে উপার্জন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

মাধবীর বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রামনাথপুর তাঁতীপাড়া গ্রামে। উপজেলার আশরাফগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মাধবী। বাবা স্বপন মহন্ত রিকশাভ্যানের চালক। মা রাধা রানী গৃহিণী। দুই বোনের মধ্যে মাধবী ছোট। আবাদি জমি নেই পরিবারটির। বসতভিটা রয়েছে পাঁচ শতক জমিতে।

মা রাধা রানী বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। পইড়বার গেইলে, চইলবার গেইলে টাকা নাগে। সেই তকনে অর (মাধবীর) বাবা অক এক বছর আগোত বিয়াও দিবার চাছিল। ছইলটা তখন খুব কান্দিছে। পরে বিয়াওটা আর দেয় নাই। গোবর কুড়ি বেচেয়া ছইলটা পড়ি ভালো এজাল (রেজাল্ট) দিছে। এ্যালা কনতো, ভত্তি হইবে কী দিয়া, খাইবে কী, থাকপে কোনটে? টাকা ছাড়া এইগলা একটাও হবার নয়। মুই কী করিম। টাকা নাই। চিন্তাতে শুকি গেনু।’

মাধবী বলে, ‘বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে স্কুল। হেঁটেই যাতায়াত করেছি। বিকেলে বাড়িতে ফিরে ডালি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। মাঠে-রাস্তায় গোবর কুড়িয়েছি। এখনো গোবর শুকিয়ে বিক্রি করি। বাবার সামান্য আয়ে সংসারই ঠিকমতো চলে না। এ অবস্থায় ভালো কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করব কীভাবে, তা নিয়ে চিন্তায় পড়েছি।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাহফুজার রহমান বলেন, ‘মাধবী মেধাবী মেয়ে। স্কুলে পড়ার সময় তাকে সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। ভালো পরিবেশ ও আর্থিক সহযোগিতা পেলে মেয়েটি ভালো কিছু করতে পারবে।’

ক্যচিংহ্লা মারমা
ক্যচিংহ্লা মারমা

মায়ের সঙ্গে দিনমজুরি করেছে ক্যচিংহ্লা
পরিবারে তীব্র অভাব। দুবেলা খাবারও ঠিকমতো জোটে না ক্যচিংহ্লা মারমার পরিবারে। তাই মায়ের সঙ্গে তাকেও দিনমজুরির কাজ করতে হয়ে। এর মধ্যেই পড়াশোনাটা চালিয়ে গেছে সে। তার ফল পেয়েছে এসএসসি পরীক্ষায়। তবলছড়ি কদমতলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে ক্যচিংহ্লা। তবে সেই অর্জনের আনন্দ ম্লান হয়ে যাচ্ছে কলেজে ভর্তির টাকা জোগাড়ের দুশ্চিন্তায়।

ক্যচিংহ্লাদের বাড়ি খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের ডাকবাংলো এলাকায়। নিজেদের বসতভিটাও নেই। থাকে স্থানীয় আনি চেয়ারম্যানের দেওয়া জায়গায়। চার বছর আগে বাবা হ্লাথোয়াই মারমা মারা যান। মা হ্রাংরা মারমা দিনমজুর। বর্তমানে তিনিও অসুস্থ। একমাত্র ছোট বোন উক্রাচিং মারমা একই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

মাটিরাঙ্গা বাজার থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে তবলছড়ি ডাকবাংলা আনি চেয়ারম্যানপাড়া এলাকা। সেখানে বেড়া আর টিনের ছাউনির জরাজীর্ণ দুই কক্ষের ঘর। বৃষ্টি হলে টিনের ফুটো বেয়ে পড়ে পানি। বাড়িতে পাওয়া গেল না ক্যচিংহ্লা মারমা আর তার মাকে। দুজন দুই জায়গায় কাজ করতে গিয়েছিলেন।

দুই ঘণ্টা পর বাড়িতে ফেরে ক্যচিংহ্লা মারমা। প্রথম আলোকে বলে, ‘ছোট থেকে দেখে এসেছি বাবা অসুস্থ। ২০১৬ সালে বাবা মারা যান। এরপর মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়েন। দুবেলা ঠিকমতো খাবার জোটেনি। তারপরও পড়ালেখা ছাড়িনি। স্কুল বন্ধের সময় মাকে সাহায্যের জন্য কাজে নেমে পড়েছি। মাটি কাটা, দিনমজুরসহ যখন যে কাজ পেয়েছি, সে কাজ করেছি। তবে প্রতিবেশী আর শিক্ষকেরা সব সময় আমাদের সহযোগিতা করেছেন। আমাদের দুই ভাই-বোনকে বই, খাতা, কলম, জামা কিনে দিয়েছেন তাঁরাই। এমনকি প্রায় সময়ই প্রতিবেশীরা খাবার দিয়েছেন। তাঁদের সহযোগিতার জন্যই এমন ভালো ফল করতে পেরেছি।’

ক্যচিংহ্লার মা হ্রাংরা মারমাও ফিরে এলেন কিছুটা সময় পর। তিনি বলেন, ‘ভালো ফল পেয়ে ছেলের খুব খুশি হওয়ার কথা। অথচ সে মন খারাপ করে বসে আছে। কলেজে ভর্তি হতে পারবে কি না, সেটাই তার চিন্তায়। কলেজে পড়তে গেলে তো এলাকার বাইরে যেতে হবে। ভর্তি হওয়া ও থাকা-খাওয়ার জন্য অনেক টাকা লাগবে। আমার তো দুবেলা ঠিকমতো খাবারই জোটে না। ছেলের পড়ালেখার খরচ পাব কোথায়? তাই মনকে শক্ত করে ছেলেকে বলেছি, গরিবের অত স্বপ্ন দেখতে নেই। পড়াশোনা বাদ দিতে বলেছি।’

বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক লিটন কান্তি দত্ত বলেন, ছেলেটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের, তবে খুবই মেধাবী। বিদ্যালয়ে প্রতিটি শ্রেণিতে প্রথম হয়ে এসেছে। তার পড়ালেখার ক্ষেত্রে শিক্ষকেরা এবং বিদ্যালয় থেকে যতটুকু সম্ভব সহায়তা করা হয়েছে। এখন কলেজে পড়তে যে টাকা লাগবে, তার বন্দোবস্ত করার সামর্থ্য পরিবারের নেই। কেউ একটু সহযোগিতা পেলে সে ভবিষ্যতে অনেক ভালো করবে।

মনিকা রানী মন্ডল
মনিকা রানী মন্ডল

টিউশনি করে পড়াশোনা চালিয়েছে মনিকা
সকালের নাশতা পান্তাভাত। তা খেয়েই টিউশনি করতে বের হতে হয়েছে। টিউশনি থেকে ফিরে বিদ্যালয়ে। শুধু পানি খেয়ে টিফিনের সময় কেটেছে। বিকেলে বাড়িতে ফিরে নাশতা হিসেবে জুটেছে চালভাজা। তারপর আবার টিউশনি। সন্ধ্যায় মায়ের সাংসারিক কাজে হাত লাগাতে হয়েছে। রাতে বেশির ভাগ সময় পড়তে হয়েছে চুলার আলোয়। এভাবে লেখাপড়া চালিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থকে জিপিএ-৫ পেয়েছে মনিকা রানী মণ্ডল।

গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর বহুমুখী পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মনিকা রানী। বাড়ি সাদুল্যাপুর উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের হবিবুল্লাপুর গ্রামে। বাবা অনন্ত কুমার মণ্ডল দিনমজুর। মা সাবিত্রী রানী গৃহিণী। নিজস্ব জায়গা-জমি নেই। অন্যের জমিতে টিনের ঘর তুলে বসবাস। মনিকার বড় ভাই তুষার কুমার মণ্ডল গ্রামে ছোট মুদিদোকান চালান।

সাদুল্যাপুর বহুমুখী পাইলট মডেল উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোছা. রেহানা খাতুন বলেন, মনিকা দরিদ্র হলেও খুব মেধাবী। পড়ালেখায় তার যথেষ্ট আগ্রহ। তাই বিদ্যালয়ের পাঠদানের পর তিনি বাসায় নিয়ে মনিকাকে আলাদা করে পড়িয়েছেন। এ ছাড়া তাকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কলেজে পড়ানোর মতো সামর্থ্য পরিবারটির নেই। তাই তিনি চান, কেউ মেয়েটির পাশে দাঁড়াক।

আবুল হাসেম
আবুল হাসেম

টিউশনি করে পড়েছে আবুল হাসেম
মা মানসিক ভারসাম্যহীন। বাবা দিনমজুর। তিন ভাইকে নিয়ে পাঁচজনের সংসার। অভাব-অনটনের কারণে ছোটবেলাতেই আবুল হাসেমকে উঠতে হয়েছে নানাবাড়িতে। তবে সেখানেও কপাল সহায় হয়নি। মাঝে নানা মারা গেছেন। তবু নানির উৎসাহে পড়ালেখা চালিয়েছে আবুল হাসেম। তবে এ জন্য তাকে টিউশনি করে টাকা উপার্জন করতে হয়েছে।

অদম্য মেধাবী আবুল হাসেম সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ক্ষুদ্র বয়রা গ্রামের বাসিন্দা। বেড়ে উঠেছে রায়গঞ্জ উপজেলার বারইভাগ গ্রামের নানাবাড়িতে। চলতি বছর স্থানীয় পাঙ্গাসী লায়লা-মিজান স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর আগে জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি পায় সে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাতেও জিপিএ-৫ পেয়েছিল।

আবুল হাসেমের বাবা নজরুল ইসলাম দিনমজুর। সম্বল বলতে বসতবাড়ির ৮ শতক জায়গা। মা হাসিনা বেগম মানসিক ভারসাম্যহীন। এক ভাই দশম শ্রেণিতে, আরেক ভাই শিশু শ্রেণিতে পড়ছে। পরিবারের অসহায় অবস্থার কথা চিন্তা করে আবুল হাসেমকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন নানি ছবুরা বেগম। সেই থেকে বারইভাগ গ্রামে থাকে সে। নানা মারা যাওয়ার পর এই পরিবারটিও অসহায় হয়ে পড়ে। নানি কাঁথা সেলাই করে কোনোমতে জীবিকা নির্বাহ করেন। ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ওঠার পর থেকে টিউশনি শুরু করতে হয় আবুল হাসেমকে। এ থেকে মাসে হাজারখানেক টাকা আয় হয়। তা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নিয়েছে সে।

এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফল পেলেও কলেজে ভর্তি নিয়ে চিন্তায় পড়েছে আবুল হাসেম। কলেজে ভর্তি হতে হলে অনেক টাকা লাগবে। দূরের কোথাও গিয়ে থাকা-খাওয়ার বাড়তি খরচ আছে। টিউশনি করে সেটা জোগাড় করা হয়তো সম্ভব হবে না।

নানি ছবুরা বেগম বলেন, ‘আমার নাতিটার পড়ালেখার প্রতি খুব আগ্রহ। কেউ একটু সাহায্য করলে তার মনের বাসনা পূর্ণ হতে পারে।’

পাঙ্গাসী লায়লা-মিজান স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক রঞ্জিত কুমার সেন বলেন, ‘এমন মেধাবী একটা ছেলের পাশে কেউ না কেউ দাঁড়াবেন বলে আমি খুবই আশাবাদী।’

আসমানী খাতুন
আসমানী খাতুন

অভাব রুখতে পারেনি আসমানীকে
প্রাইভেট পড়া দূরের কথা, অভাবের সংসারে ঠিকমতো খাবারও জোটেনি আসমানী খাতুনের। একটা ভালো পোশাকও ছিল না তার। সহপাঠীরা যখন যানবাহনে চেপে স্কুলে গেছে, তখন আসমানীকে চার কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে। এত কষ্টের মধ্যেও এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

আসমানী খাতুন ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ডাউটি গ্রামের ওলিয়ার রহমান মোল্যার মেয়ে। সে স্থানীয় কোলাবাজার ইউনাইটেড হাইস্কুল থেকে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। মেয়ের এমন ভালো ফলে হতদরিদ্র মা-বাবা খুশি হলেও চিন্তা বেড়েছে কীভাবে তার কলেজের পড়ালেখার খরচ চালাবেন।

ডাউটি গ্রামে একখণ্ড জমির ওপর ভাঙাচোরা মাটির ঘর। এই ঝুপড়িতেই আসমানীদের বসবাস। বাবা ওলিয়ার রহমান মোল্যা বলেন, ‘ভিটেটুকু ছাড়া চাষযোগ্য কোনো জমি নেই। সারা বছর পরের খেতে কামলা খেটে সংসার চালাতে হয়। সব সময় কাজও থাকে না। সবাই বলছে, মেয়ে ভালো ফল করেছে। এখন কলেজে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু কীভাবে কলেজে পড়ানোর খরচ পাব?’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুল ওহাব জোয়ার্দার বলেন, একটু সহযোগিতা পেলে মেয়েটা অনেক বড় হতে পারবে।

রুহুল আমীন
রুহুল আমীন

কাঠ চেরাইয়ের কাজ করেছে রুহুল আমীন
বাবা ওহাব আলী সরদার করাতকলে জ্বালানি কাঠ চেরাই করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করেন। ছেলে রুহুল আমীনও বাবার কাজে হাত লাগিয়েছে নিয়মিত। কোনো দিন ওহাব কাজ করতে না পারলে পুরো কাজ রুহুলকেই সামলাতে হয়েছে। জীবন-জীবিকার এই সংগ্রামের মধ্যেই পড়াশোনা চালিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

রুহুল আমীন পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার খেপুপাড়া সরকারি মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়। কলাপাড়া পৌর শহরের গোডাউন ঘাট এলাকায় অন্যের জমিতে খুপরিঘরে বসবাস তার পরিবারের। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে সবার ছোট। পড়াশোনা করে চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখে সে। রুহুল আমীনের মা আকলিমা বেগম বলেন, ‘পোলাডায় ল্যাহাপড়াও করছে, আবার অর বাপের লগে কামও করছে। হেইয়ার পর যেডু সময় পাইছে, হেই সময়ডুই পড়ছে। হুনছি ও ভালো পাস করছে।’

বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিম খান প্রথম আলোকে বলেন, রুহুল অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু সামনে তার পড়াশোনা কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে শ্রমজীবী পরিবারটি। উচ্চশিক্ষার জন্য সহায়তা পেলে সে ভবিষ্যতেও ভালো ফল করবে।

[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ; প্রতিনিধি, গাইবান্ধা, খাগড়াছড়ি, দাউদকান্দি, রায়গঞ্জ, বদরগঞ্জ ও কলাপাড়া]