দিনমজুরদের রক্তে লাল পিচঢালা কালো পথ

>

চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি। ছবিটি পারকৃষ্ণপুর–মদনা ইউনিয়নের বড়বলদিয়া গ্রাম থেকে তোলা l শাহ আলম
চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদায় সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি। ছবিটি পারকৃষ্ণপুর–মদনা ইউনিয়নের বড়বলদিয়া গ্রাম থেকে তোলা l শাহ আলম

সড়ক দুর্ঘটনা

গতকাল ২০ জনসহ ৪৫ দিনে নিহত ২০

ট্রাকের ধাক্কায় চূর্ণবিচূর্ণ হওয়া ভটভটিটি (আলমসাধু) মহাসড়কের ওপর পড়ে আছে। পিচঢালা কালো পথ রক্তে লাল। মহাসড়কের ওপর ও আশপাশে ছড়িয়ে আছে শরীরের ছিন্নভিন্ন অংশ। পড়ে আছে গামছা দিয়ে বাঁধা টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার—আলুভর্তা ও ডিম ভাজি। পাশেই কোদাল, শাবল, মাথাল, ছেঁড়া স্যান্ডেল, গামছা ও লুঙ্গি।

এ দৃশ্য চুয়াডাঙ্গা-জীবননগর মহাসড়কের চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর বটতলা এলাকার। গতকাল রোববার সকালে সেখানে ভয়াবহ এক সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ১২ জন একই গ্রামের বাসিন্দা। ভটভটি ও ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষের ওই ঘটনায় আহত হয়েছন আরও নয়জন। এর মধ্যে চারজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

এ ছাড়া গতকাল ঢাকাসহ চার জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও সাতজন। এ নিয়ে গত ৪৫ দিনে বিভিন্ন জেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারালেন ৪২০ জন।

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, ভটভটিতে করে দামুড়হুদার বড় বলদিয়া গ্রাম থেকে আলমডাঙ্গার মুন্সিগঞ্জে রাস্তার কাজ করতে যাচ্ছিলেন ২২ জন শ্রমিক। চালক নিজেও শ্রমিক ছিলেন। জয়রামপুর স্কুলের কাছে পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আসা বালুভর্তি একটি ট্রাক হঠাৎ রাস্তার ডান পাশে গিয়ে ভটভটিকে মুখোমুখি ধাক্কা দেয়। এরপর ধাক্কা দিতে দিতে রাস্তার বাঁ পাশে নিয়ে ফেলে দেয় ভটভটিকে। হতাহত শ্রমিকদের আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসেন। ততক্ষণে ট্রাক ফেলে চালক ও সহকারী পালিয়ে যান।

নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আটজন ঘটনাস্থলে, সদর হাসপাতালে তিনজন, দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে একজন মারা যান।

নিহত ব্যক্তিরা হলেন দামুড়হুদা উপজেলার পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের বড় বলদিয়া গ্রামের আবদার হোসেন (৪৮), বিল্লাল হোসেন (৪০), আবু বকর সিদ্দিক (৪৩), ইজ্জত আলী (৬০), নজির আহমেদ (৩০), শান্ত আহমেদ (২২), হাফিজুর রহমান (৪০), বিল্লাল মণ্ডল (৩৫), রফিকুল ইসলাম (৩৫), জজ হোসেন (২৮), লাল মোহাম্মদ (৩৫) ও শাহীন হোসেন (৩৫)। দুর্ঘটনায় আহত নয়জনের মধ্যে চারজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁরা হলেন মজিবর রহমান (২২), শরীফ হোসেন (৪২), আতিকুল ইসলাম (২৫) ও নুর ইসলাম (৪৫) এবং পাশের সুলতানপুর গ্রামের শফিকুল ইসলাম (৩৫)।

দুর্ঘটনার পর এলাকাবাসী সড়ক অবরোধ করলে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দামুড়হুদা সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মো. কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে এক ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল শুরু হয়।

সদর হাসপাতালে লাশ ও আহত ব্যক্তিদের পৌঁছানোর খবরে তাঁদের স্বজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা দ্রুত সেখানে ছুটে আসেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও এলাকাবাসীর পক্ষে পারকৃষ্ণপুর-মদনা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জাকারিয়া আলমের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লাশগুলো ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফনের অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক সায়মা ইউনুস।

সারি সারি ১২ কবর

দুপুরে দামুড়হুদার বড় বলদিয়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামের কবরস্থানে ১২ জনের জন্য সারি সারি করে খোঁড়া ১২টি কবর। একসঙ্গে ১২ জনের মৃত্যুতে গোটা গ্রাম আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে। বাড়িতে বাড়িতে চলছে মাতম।

দুপুরের পর বাড়িতে পৌঁছায় ১২ জনের লাশ। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বড় বলদিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে কয়েজ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে নিহত ব্যক্তিদের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে স্থানীয় গ্রামের কবরস্থানে দুই সারিতে ৬ জন করে ১২ জনকে পাশাপাশি দাফন করা হয়। দাফনকালে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের আর্তনাদে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়।

জানাজা ও দাফনের সময় দামুড়হুদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল হাসান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজাদুল ইসলাম আজাদসহ এলাকা ও আশপাশের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান খাজা আবুল হাসনাত ঘোষণা দেন, হতাহত প্রতিটি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।

রাজধানীতে শিক্ষক নিহত

ভাটারা থানা এলাকার নতুন বাজারে গতকাল সকালে বাসের চাপায় তৃপ্তি শংকর তালুকদার (৬০) নামের এক স্কুলশিক্ষক নিহত হয়েছেন। তিনি ভাটারার বাঁশতলায় অবস্থিত ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। তৃপ্তি শংকর সরকার সপরিবার মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সি-ব্লকে থাকতেন। গতকাল সকালে তিনি ক্যামব্রিয়ান কলেজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হন। সকাল নয়টার দিকে বাড্ডার নতুন বাজারে বাস থেকে নেমে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় যাত্রীবাহী একটি বাস তাঁকে চাপা দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

দুর্ঘটনায় নিহত আরও ৬

খুলনার ডুমুরিয়ায় একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে চারজন নিহত হয়েছেন। তাঁরা হলেন গোলক মিস্ত্রি (২২), লাল্টু সরদার (২৮), রাজেশ সরদার (২৫) ও কৃষ্ণপ্রসাদ মণ্ডল (২৪)। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১৬ জন। গতকাল বিকেলে উপজেলার বালিয়াখালি ব্রিজের পাশে নতুন রাস্তা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ডুমুরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুভাষ বিশ্বাস জানান, ভাড়া করা বাসটি গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দি এলাকায় অবস্থিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যাওয়ায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তিদের সবার বাড়ি ওই গ্রামে। গাড়িটিতে অন্তত ৪০ জন যাত্রী ছিলেন।

সিরাজগঞ্জের বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কে উল্লাপাড়ার শ্যামলীপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যাত্রীবাহী বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে রওশন আলী (৫৫) নামের এক ডাল ব্যবসায়ী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। গতকাল বেলা ১১টায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।

হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল কাদের জানান, ঘটনার সময় রওশন মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। এ সময় সিরাজগঞ্জ থেকে পাবনাগামী একটি বাস চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। বাসটি আটক করা হয়েছে।

হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজার এলাকায় গতকাল দুপুরে একটি পাজেরো জিপের চাপায় রিফাত মিয়া (৭) নামের এক শিশু নিহত হয়েছে। সে একই উপজেলার বনগাঁও গ্রামের আবদুর রাজ্জাকের ছেলে।

পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, হবিগঞ্জ কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট ডিভিশনের জিপটি দুপুরে বাহুবলের দিকে যাচ্ছিল। সুঘর নামক স্থানে পৌঁছালে সড়ক পার হওয়ার সময় রিফাতকে ধাক্কা দেয় গাড়িটি। এতে সে গুরুতর আহত হয়। তাকে প্রথমে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যায়।