দিলারার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

বাঁশখালীর সাধনপুরে স্থানীয় নারী উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছেন দিলারা আনোয়ার । প্রথম আলো
বাঁশখালীর সাধনপুরে স্থানীয় নারী উন্নয়ন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করছেন দিলারা আনোয়ার । প্রথম আলো

‘তখনকার দিনে মেয়েদের বেশি পড়ালেখা করাটা ভালো চোখে দেখত না সমাজ। অনেকে একে পাপ মনে করত। মেয়ে একটু বড় হলেই পাড়ার খারাপ ছেলেদের কুদৃষ্টি পড়ত তাদের ওপর। তাই ষষ্ঠ শ্রেণী পাস করার পরই মা আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। বললেন, “মেয়েদের অত বেশি পড়ালেখা করতে হয় না।” মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ঠিক করলাম, স্কুলে যেতে না পারলেও ঘরে পড়ে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে উচ্চশিক্ষা আমি নেবই। দেখিয়ে দেব শিক্ষা পাপ নয়, বরং সমাজকে আলোকিত করার হাতিয়ার।’
যেমন কথা তেমন কাজ। ঘরে পড়েই প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। আগ্রহ দেখে তাঁর বাবা তাঁকে ভর্তি করালেন চট্টগ্রাম কলেজে। কিন্তু এবারও বাধা সমাজের। কলেজে ভর্তির অপরাধে পরিবারকে সমাজচ্যুত করলেন মাতবরেরা। বাধ্য হয়েই পড়ালেখার ইতি টেনে ১৯৬১ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন দিলারা আনোয়ার।
গল্পের এখানেই শেষ নয়। সমাজচ্যুত একটি গ্রামের মেয়ে এরপর কীভাবে দুই ছেলেকে মানুষ করার পাশাপাশি নিজেও (ম্যাট্রিক পাসের ২৬ বছর পর) ইন্টারমিডিয়েট এবং বিএ-বিএড পাস করে নারীশিক্ষা ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক হয়ে ওঠেন, আসল গল্পটা সেখানেই।
দিলারার জন্ম ১৯৪১ সালে বাঁশখালী উপজেলার পশ্চিম সাধনপুর গ্রামে। বাবা মুন্সি আবদুর রাজ্জাক ছিলেন জমিদারি এস্টেট তদারককারী। স্বামী আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন ডাক বিভাগের কর্মচারী। দিলারা প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। চতুর্থ ও ষষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পেয়ে পড়ালেখায় ভীষণ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কলেজে ভর্তি হয়েও পড়তে পারেনি। ভেতরে আগুন তাই ছাইচাপা ছিল। ছেলেদের পড়ালেখা করানোর ফাঁকে নিজেকেও প্রস্তুত করেন প্রাইভেটে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। ১৯৮১ সালে বড় ছেলে এইচএসসি পাস করার পরের বছর তিনিও আইএ পাস করেন বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ থেকে। এরই মধ্যে ১৯৮০ সালে সাধনপুরে বালিকা উচ্চবিদ্যালয় স্থাপিত হলে উদ্যোক্তারা মুসলমান পরিবারের মেয়ের সন্ধান করছিলেন ভর্তির জন্য। সে সঙ্গে নারী শিক্ষিকাও। দিলারা বিনা বেতনে (দুই বছর) শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়েন মেয়েশিক্ষার্থীর খোঁজে। চার ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করা এ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী বর্তমানে প্রায় চার শ। এদিকে শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৮৪ সালে বিএ এবং ১৯৮৬-৮৭ সালে বিএড পাস করেন প্রাইভেটে। মা-ছেলের একই সঙ্গে পড়ালেখা এবং পাসের খবর এলাকায় তখন ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এরই মধ্যে নারীশিক্ষা এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কাজও চালিয়ে যান দিলারা। কাজে গতি আনার লক্ষ্যে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘শহীদ স্মৃতি মহিলা সমিতি।’ যুক্ত হন ঢাকার নারীপক্ষের সঙ্গে। সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে শতাধিক নারী নির্যাতন ঘটনার নিষ্পত্তি করেছেন।
১৯৯১-৯২ সালে মহিলা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এলাকার ২৫-৩০ জন নারী নিয়ে শুরু করেন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। প্রায় ৪০০ নারী এ সমিতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছেন।
দিলারা ২০০২ সালে বিদ্যালয় থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে অবসর নিয়ে এলাকার শিশুদের উন্নত শিক্ষা দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন শহীদ মেমোরিয়াল কিন্ডারগার্টেন। এভাবে শিক্ষা ও সমাজ উন্নয়নে অবদানের জন্য এ বছর ৯ ডিসেম্বর রোকেয়া দিবসে বাঁশখালীর ‘শ্রেষ্ঠ জয়িতা’ পুরস্কার পান তিনি। তাঁর ছেলেরাও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে ওয়াহিদুল ইসলাম ব্যাংকার। ছোট ছেলে জিয়াউল হক ও তাঁর স্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী।
৭৩ বছর বয়স এখন। কিন্তু উদ্যমে ভাটা পড়েনি। গ্রামের মেয়েদের সংগঠিত করার কাজটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। বললেন, ‘প্রতি তিন মাস পর মহিলা সমিতির সদস্যদের নিয়ে বাড়িতে বৈঠক করি, তাদের উৎসাহ-পরামর্শ দিই। আমার বিশ্বাস, একদিন সমাজের সব নারী শিক্ষিত হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন, প্রমাণ করবেন মা-বোন ও স্ত্রীর পরিচয়ের পাশাপাশি মানুষ হিসেবেও একটা পরিচয় তাঁদের আছে।’