দিল্লি, নিউইয়র্ক, লন্ডনে শহীদ স্মরণ

ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিউইয়র্কের ‘মাতৃভাষা’ ভাস্কর্যের সামনে সমবেত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিসহ দেশি-বিদেশি মানুষ l ছবি: প্রথম আলো
ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নিউইয়র্কের ‘মাতৃভাষা’ ভাস্কর্যের সামনে সমবেত যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিসহ দেশি-বিদেশি মানুষ l ছবি: প্রথম আলো

দেশের মতোই যথাযোগ্য মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে বিদেশেও উদ্যাপিত হলো মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে গতকাল রোববার প্রতিবেশী ভারত থেকে শুরু করে সুদূর নিউইয়র্ক ও লন্ডনেও আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। তাতে ফুলেল শ্রদ্ধা আর অশ্রুসিক্ত ভালোবাসায় সম্মান জানানো হয় এ দেশের ভাষাশহীদদের প্রতি। অনুষ্ঠানে অংশ নেন দলমত-নির্বিশেষে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
ঢাকায় যখন একুশের প্রথম প্রহর, নিউইয়র্কে তখন ২০ ফেব্রুয়ারি, বেলা একটা। জাতিসংঘ সদর দপ্তরের উল্টো দিকে, দাগ হ্যামারশোল্ড প্লাজার নাগরিক উদ্যানে ‘মাতৃভাষা’ ভাস্কর্যের কাছে অধীর অপেক্ষায় ছিলেন কয়েক শ বাঙালি। তাঁদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি অতিথিরা। ফেব্রুয়ারির এই সময় নিউইয়র্ক শীতে কাতর থাকার কথা, অথচ খেয়ালি প্রকৃতি বসন্তের আগাম বার্তা নিয়ে হাজির। অধিকাংশের হাতেই ছিল ফুল। কারও হাতে পুষ্পস্তবক। সবাই এসেছিলেন ভাষাশহীদের স্মরণে একুশকে বরণ করে নিতে।
এই প্রথম বাংলাদেশের সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিউইয়র্কবাসী একুশকে বরণ করলেন। স্থানীয় সময় বেলা ১টা ১ মিনিটে প্রথমে ফুল নিয়ে শ্রদ্ধা জানাল ছয় বছরের বালক আয়ান। তারপর একে একে শ্রদ্ধা জানালেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল শামীম আহসান, নিউইয়র্কের কুইন্স বরো প্রেসিডেন্ট মেলিন্ডা কাৎজ, নিউইয়র্কের অভিবাসন কমিশনার নিশা আগারওয়াল, ফিলাডেলফিয়ার ডেপুটি মেয়র বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নীনা আহমেদ প্রমুখ। এ সময় নিউইয়র্কের গভর্নরের একটি বাণী হস্তান্তর করেন তাঁর বিশেষ প্রতিনিধি হার্শ পারেখ। পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের পাশাপাশি ছিল প্রবাসী কবিদের স্বরচিত কবিতা পাঠ ও উদীচীর পরিবেশনায় একুশের গান।
একই দিন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনের উদ্যোগে মিশন ভবনে বিদেশি কূটনীতিকদের অংশগ্রহণে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদ্যাপিত হয় এই দিবস। রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এ অনুষ্ঠানে জানান, আগামী বছর থেকে জাতিসংঘ সদস্যদের নিয়ে নিউইয়র্কে সম্মিলিতভাবে একুশে উদ্যাপনের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে জ্যাকসন হাইটসের ডাইভারসিটি প্লাজায় নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানান প্রবাসী ব্যক্তি ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পৃথক অনুষ্ঠান আয়োজন করে নিউইয়র্ক বাংলাদেশ সোসাইটি। কুইন্সে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠান। এ ছাড়া সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে নিউইয়র্কের বিভিন্ন বাংলাদেশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
লন্ডনে অমর একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে এবারই প্রথম অনুষ্ঠিত হয়েছে একুশের প্রভাতফেরি। এতে নারী ও শিশুদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বাঙালির অহংকার আর শোকের দিবসটি উদ্যাপনে শনিবার মধ্যরাতেই পূর্ব লন্ডনের আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে ভিড় জমে।
একুশের প্রথম প্রহরে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম এ হান্নান ও স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রবাসী নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনেও অনুষ্ঠিত হয় এক আলোচনা সভা।
ভারতের কলকাতায়ও একুশে স্মরণে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। শনিবার বিকেলে একাডেমি অব ফাইন আর্টস চত্বরে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ থেকেও যোগ দেন ২৫ জন শিল্পী। যৌথভাবে পরিবেশন করা হয় সংগীত, নাটক ও নৃত্য। রাত ১২টা ১ মিনিটে মশাল মিছিল হয় এই চত্বরে। সকালে পার্ক সার্কাস এলাকায় বাংলাদেশ উপহাইকমিশন গ্রন্থাগার থেকে বের হয় প্রভাতফেরি। এখানে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে শুরু হয় এ দিনের নানা অনুষ্ঠান। চলে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান আয়োজন করে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমি, কলকাতার ভাষাশহীদ স্মারক সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরও। ভাষাসৈনিক বরকতের গ্রাম বাবলাতেও আয়োজন করা হয় নানা কর্মসূচি।
ভারতের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে সকালে শ্রদ্ধা জানানো হয় ভাষাশহীদদের প্রতি। তারপর বের করা হয় একটি মনোজ্ঞ শোভাযাত্রা। ত্রিপুরা সরকার আয়োজিত একুশের মূল অনুষ্ঠানটি হয় বিকেলে আগরতলা বইমেলা প্রাঙ্গণে।
বাসস জানায়, ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে ভাষাশহীদের শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশন প্রাঙ্গণে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। পরে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। সন্ধ্যায় হাইকমিশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এদিকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপনে গতকাল সকালে সিঙ্গাপুরে বাংলা ভাষাভাষী জাংদি প্রাথমিক স্কুল ও জুইং প্রাথমিক স্কুলে সমবেত হয় কয়েক শ শিশু ও তাদের অভিভাবক। শহীদ মিনারের বেদিতে এ সময় ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিশেষ প্রতিনিধি, যুক্তরাষ্ট্র; নিউইয়র্ক, লন্ডন, কলকাতা ও ত্রিপুরা প্রতিনিধি}