দিল্লিতে গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ

একাত্তরে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর, মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের একাদশ অধ্যায়ের শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।

মঈদুল হাসান

বিমানযাত্রায় থর্নার যাঁদের নাম বলেছিলেন, তার মধ্যে পি এন হাকসারের নামও উল্লেখ করেছিলেন। আমি থর্নারকে জিজ্ঞেস করি তিনি তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চেনেন কি না। থর্নার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ওহ্‌, সেই ১৯৩৯ সাল থেকে, যখন আমরা দুজন এবং কখনো মাঝেমধ্যে কৃষ্ণ মেনন ও সেলভেঙ্করকে নিয়ে গাওয়ার স্ট্রিটে (লন্ডনে) ঘুরে বেড়াতাম। ফ্যাসিবাদের কালো মেঘ যখন ইউরোপে দ্রুত বিস্তার লাভ করছিল এবং অসম্ভব সব স্বপ্ন দেখতাম আমরা।

পরদিন মেজর জেনারেল বি এন সরকার আগের সন্ধ্যায় তোলা সুব্রাহ্মনিয়ামের প্রশ্নের অনুসন্ধান চালিয়ে যান। তিনি দুপুরের খাবার সময়ের পর অশোক মিত্রের বাড়িতে আসেন কোনো পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতের সময়সূচি ছাড়াই। সাধারণ শাট৴-প্যান্টের বেসামরিক পোশাকে। তিনি খুবই সহজভাবে আমার কাছে নিজের পরিচয় দেন, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশর সামরিক সচিব হিসেবে।

অতীত দিনের স্মৃতি রোমন্থনের মাঝখানে তিনি বললেন, আমি যদি হাকসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই, তাহলে তিনি তার ব্যবস্থা করতে পারেন।

আমি বললাম, সেটা করতে পারলে আমি খুবই আনন্দিত হব। তাঁকে জানালাম না যে হাকসারই হলেন একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আদিষ্ট হয়েছি।

ওই উড়ানে দ্বিতীয় সৌভাগে৵র ঘটনাটি ছিল থর্নার যখন জানতে পারলেন যে দিল্লিতে আমার থাকার কোনো জায়গা নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন দিল্লিতে তাঁর বন্ধু ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. অশোক মিত্র তাঁর বাড়িতে থর্নারের জন্য আতিথেয়তার যে ব্যবস্থা করেছেন তার অংশভাগী হতে।

দিল্লিতে কয়েকজন খুব গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে তাঁরা দুজনই নিঃসন্দেহে আমার সহায়ক হয়েছিলেন। মে থেকে নভেম্বরের মধ্যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দুজন শীর্ষ নীতি উপদেষ্টা পি এন হাকসার ও ডি পি ধরের সংস্পর্শে থাকার কাজে দিল্লির লোধি এস্টেটে অশোক মিত্রের বাড়ি প্রায়ই আমার আবাসস্থল হয়ে উঠত।

ভারতীয় চিন্তাবিদের সঙ্গে মতবিনিময়

দিল্লিতে দুজন সম্পাদক, হিন্দুস্তান টাইমস–এর বি জি ভার্জিস ও টাইমস অব ইন্ডিয়ার গিরিলাল জৈন আমাকে এক বিরল সুযোগ করে দিয়েছিলেন নৈশভোজের আয়োজন করে। সেখানে প্রায় আধা ডজন নেতৃস্থানীয় ভারতীয় চিন্তাবিদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ হয়। যাঁরা সেখানে কোনো না কোনোভাবে ভারতের বাংলাদেশ সংকটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও পাকিস্তানে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে পরিচিত জি পার্থসারথি। তিনিই আমাকে অধিকাংশ অনুসন্ধানী প্রশ্ন করেন ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মধ্যে বিরোধ কীভাবে মিটতে পারে, সে বিষয়ে।

আরেকজন ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিসের পরিচালক কে সুব্রাহ্মনিয়াম। তিনি বুঝতে চেষ্টা করেন বিদ্রোহী সেনা অফিসারদের মধ্যে ইতিমধ্যে কোনো রণনীতিগত চিন্তা দানা বেঁধেছে কি না এবং রাজনৈতিক নেতারা এই সশস্ত্র সংগ্রামকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য কী চিন্তাভাবনা করছেন।

পরদিন মেজর জেনারেল বি এন সরকার আগের সন্ধ্যায় তোলা সুব্রাহ্মনিয়ামের প্রশ্নের অনুসন্ধান চালিয়ে যান। তিনি দুপুরের খাবার সময়ের পর অশোক মিত্রের বাড়িতে আসেন কোনো পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতের সময়সূচি ছাড়াই। সাধারণ শাট৴-প্যান্টের বেসামরিক পোশাকে। তিনি খুবই সহজভাবে আমার কাছে নিজের পরিচয় দেন, ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মানেকশর সামরিক সচিব হিসেবে।

বি এন সরকার আলাপের সূত্রপাত করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অনিয়মিত যুদ্ধের জন্য অবকাঠামো স্থাপনের প্রসঙ্গ নিয়ে। যে বিষয়টি পূর্ববর্তী সন্ধ্যায় গিরিলাল জৈনের বাড়ির আলোচনায় উঠেছিল। কিন্তু অসমাপ্ত থেকে যায়। বি এন সরকার আলোচনার সূচনা করেন ব্রিটিশ আমলের একটি পুরোনো জরিপ মানচিত্র (সার্ভে ম্যাপ) খুলে ধরে, সম্ভাব্য গোপন অভিযান পথের দিকনির্দেশ করতে। কিন্তু তা অনুপযোগী হওয়ায় পরদিন আবার একগুচ্ছ সাম্প্রতিক সময়ের মানচিত্র আনা হয়।

খুঁটিনাটির দিক থেকে সেটাও অসম্পূণ৴ বিধায় ঢাকা শহর লাগোয়া দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের এলাকাগুলো যেখান দিয়ে আমরা ভারতীয় সীমান্ত শহর আগরতলায় যাওয়া–আসার পথ হিসেবে ব্যবহার করতাম, তা চিহ্নিত করতে পারিনি। এই প্রচেষ্টা পরবর্তী সময়ে আর অনুসরণ করা হয়নি। তবে একটা ধারণা আমি পেয়েছিলাম যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্টাফ ওয়ার্ক সম্ভবত শুরু হয়ে গেছে।

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি জি পার্থসারথির বাসভবনে যাই আগের দিন সন্ধ্যার নিমন্ত্রণের ধারাবাহিকতায়। পার্থসারথির বাসভবনে শুধু দুজন ছিলেন। একজন ভারতের পরিকল্পনামন্ত্রী সি সুব্রাহ্মনিয়াম। অপরজন পররাষ্ট্রসচিব টি এন কল।

আমাদের মধ্যে অনেক প্রশ্ন ও উত্তরের আদান-প্রদান হয়। কিন্তু সুব্রাহ্মনিয়াম ও কল তেমন কোনো ইঙ্গিত দেননি। বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত কোনো নীতি স্থির করতে পারেনি তখন পর্যন্ত। আট দিনব্যাপী চলা এসব আলোচনা ও মতবিনিময় হাকসারের কাছে আমার উপস্থাপিতব৵ নীতি প্রস্তাবকে উন্নত করতে যথেষ্ট সাহায্য করে।

হাকসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ

৩০ মে রোববার দুপুর ১২টায় হাকসারের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎসূচি স্থির করেছিলেন ড্যানিয়েল থর্নার। সে অনুযায়ী আমরা দুজনই হাকসারের বাসভবনে গেলাম তাঁর সঙ্গে কফিপানের আমন্ত্রণে। আমার জন্য বরাদ্দ সময় খুবই সংক্ষিপ্ত হতে পারে, এটা ধরে নিয়ে হাকসারের কাছে উপস্থাপন করার জন্য আমি আমার ভাবনাগুলো সংহত করেছিলাম নিম্নলিখিত ধারাবাহিকতায়।

সামনে এগোনোর কোনো স্পষ্ট পথ নেই। শরণার্থীর ঢল ভারতে এক অদৃষ্টপূর্ব রাজনৈতিক সংকট প্রজ্বলিত করতে পারে।

খণ্ড খণ্ডভাবে করা আমাদের বিচ্ছিন্ন লড়াই বড় ধরনের কোনো সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে না। তা বরং পাকিস্তানিদের প্রতিশোধের স্পৃহা আরও বাড়াবে। যার ফলে শরণার্থী আগমন বহুলাংশে বাড়বে। তখন কোনো রাজনৈতিক সমাধানও কাজে আসবে না।

বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা সম্পূর্ণ না সরানো পর্যন্ত শরণার্থীরা ফিরে যাওয়ার কোনো ভরসাই পাবে না। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার ভয়ে সামরিক জান্তাও সেনা প্রত্যাহার করবে না। কেবল সম্পূর্ণ মুক্ত বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরে যাবে।

বাংলাদেশকে মুক্ত করতে হলে একটা সুচিন্তিত রণকৌশল অনুযায়ী বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষিত ও যুদ্ধে নিয়োগ করা প্রয়োজন।

পাকিস্তান এই কৌশল বাধাগ্রস্ত করতে পারে একটা অতর্কিত যুদ্ধের মাধ্যমে। চীনের যোগসাজশে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মনোযোগ বিভ্রান্তকারী আক্রমণ সূচনার পর বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প অতকি৴ত আক্রমণ করে। কেবল সোভিয়েত ইউনিয়নকেই চীনকে সংযত রাখা ও ভারতের নিরাপত্তা ঘাটতি মেটানোর কাজে উপায় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারণ, চীন সীমান্তে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরাট বাহিনীর উপস্থিতি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি সোভিয়েত ঔদাসীন্য কাটাতে একটা আদর্শগত বিন্যাস ঘটানো যেতে পারে আওয়ামী লীগ ও দুটি মস্কোপন্থী দল তথা সিপিবি ও ন্যাপকে নিয়ে একটা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। রাজনৈতিক অবকাঠামো তৈরির একটি সাধারণ কর্মসূচি নিয়ে এই ঐক্য দেশের গভীর অভ্যন্তরে সুসমন্বিত আক্রমণ চালাতে সহায়তা করতে পারে।

সবশেষে ভারতের দরকার হবে তার সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত করে তোলা একটা চূড়ান্ত আঘাত হানা ও শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার শর্তগুলো পূরণ করার জন্য।

হাকসার অখণ্ড মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনলেন। ভারতের অভ্যন্তরে বিদ্রোহী ইবিআর ও ইপিআর শিবিরগুলোতে আক্রমণ চালাতে পাকিস্তানকে সুযোগ করে দিতে চীন কীভাবে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে গোলযোগ সৃষ্টি করতে পারে। তার প্রতিবিধানে সোভিয়েত নিরাপত্তা সহায়তা লাভের জন্য ভারতকে যে সচেষ্ট হতে হবে, তার সবটুকু শুনলেন।

বিশ্রামরত একদল মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: আনন্দবাজার পত্রিকার (ভারত) সৌজন্যে

একমাত্র যে প্রশ্নটি তিনি করলেন, এ রকম কেউ কি আছেন যিনি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এমন নেতৃত্ব দিতে পারেন? যার ফলে বামপন্থী দলগুলোর সঙ্গে একটা ফ্রন্ট গঠন সম্ভব হবে।

তাজউদ্দীন, আমি উত্তর দিলাম। সঙ্গে যোগ করলাম, তাজউদ্দীনই চেয়েছিলেন যে আমি আপনার কাছে এই দৃশ্যপট উপস্থাপন করি। কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করতে আমি কিছুটা সময় নিয়েছি। আংশিকভাবে তার কারণ আমি দিল্লির পরিপ্রেক্ষিত বুঝতে চেয়েছিলাম।

এরপর হাকসার কোনো একজনকে ফোন করে বললেন, প্রফেসর সাব, আপনি আমার এখানে এসে উপস্থিত যা আছে তা দিয়ে আমাদের সঙ্গে আহার করুন না কেন? বাংলাদেশ থেকে একজন অতিথি এখানে আছেন। হাকসার ফোন করার পরপরই এসে যোগ দিলেন অধ্যাপক পি এন ধর। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা।

তারপর প্রাসঙ্গিক বিষয়ে আলোচনা আরও কিছু সময় চলল। কিন্তু ভারত এরপর কী উদ্যোগ বা কার্যক্রম গ্রহণ করতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে হাকসার কোনো ইঙ্গিত দিলেন না। তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন দুই দিন পর জুনের ১ তারিখ সাউথ ব্লকে তাঁর অফিসে গিয়ে দেখা করতে। আমার ধারণা, মাঝখানের দিনটিতে টেলিফোনে তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার বিষয়ে তাঁর কথা হয়েছিল। কারণ, পরদিন তাঁর যোগাযোগের ধরনের মধ্যে এটা প্রতিফলিত হয়েছিল।

নিজের দপ্তরে হাকসার ছিলেন অনেক সহজ আর কথা বলায় অনেক আগ্রহী। প্রথমত, তিনি খুঁজে দেখতে চাইলেন বাংলাদেশের অন্য দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠন করা কত দূর সম্ভব। কারণ, তাঁর জানা ছিল আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা এই ধরনের উদ্যোগের বিরোধী। এটার কোনো সঠিক বাস্তববাদী সমাধান আমাদের জানা ছিল না। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তাজউদ্দীনই বিষয়টির সামাল দেবেন। যেহেতু তিনি নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নকে যেভাবেই হোক রাজি করাতে হবে ভারতকে নিরাপত্তার আচ্ছাদন দিতে।

ওই দিন হাকসার বরং জোর দিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নকে সহানুভূতিশীল করে তুলতে অধিকতর প্রচেষ্টা নেওয়ার ওপর। সেই লক্ষ্যে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিত্ব করে এমন কেউ এবং সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের প্রতিনিধির মধ্যে সময় সময় অনানুষ্ঠানিক মতবিনিময় হওয়া উচিত।

তাজউদ্দীনের কাছে আমি উভয় বিষয় রিপোর্ট করি। এ ছাড়া দিল্লির সার্বিক পরিস্থিতির চিত্র সম্পকে৴ আমি তাঁকে বলি। ভারত সরকার সব শরণার্থী ফেরত পাঠানোর পক্ষে বদ্ধপরিকর। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব হবে, তখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি। সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত সাহায্য করে না বৃহৎ শক্তিগুলোর জন্য পথ খোলা রেখে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করে। যাতে সব শরণার্থী ফিরিয়ে নেওয়া যায়। যদিও বেশি দিন দুটো লক্ষ একসঙ্গে উন্মুক্ত রাখা সম্ভব নয়।

এদিকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের অবয়ব বাড়তে শুরু করে জুনের শুরু থেকে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন অংশকে পাঁচটি অঞ্চলে ভাগ করে বেসামরিক প্রশাসনের আলাদা পাঁচজন আঞ্চলিক কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত করা হয়। প্রত্যেক আঞ্চলিক অফিসকে দায়িত্ব দেওয়া হয় সন্নিহিত শত্রু-অধিকৃত এলাকার কয়েকটি জেলার সঙ্গে একত্রে কাজ করার মতো সম্পর্ক তৈরি করতে।

এর আগে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সাবেক ইবিআর, ইপিআর ও সশস্ত্র পুলিশের বিদ্রোহী অংশগুলোকে একত্র করে বাংলাদেশ বাহিনী (Bangladesh Force) গঠন করে একটি নতুন ইউনিফর্ম ও একক নেতৃত্বের অধীনে একত্র করা হয়েছিল।

৯ মে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিযুক্ত করা হয়েছিল নতুন রিক্রুট করা বাংলাদেশের তরুণদের প্রশিক্ষিত করার জন্য। যাতে তাদের অধিকৃত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা (এফএফ) হিসেবে নিয়োগ করা যায়। সীমান্ত এলাকায় তাঁদের চলাচলে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনী পাকিস্তানি সীমান্ত ফাঁড়িগুলো (বিওপি) ধ্বংস করতে শুরু করে। জুনের শেষে প্রায় তিন থেকে চার হাজার নবপ্রশিক্ষিত এফএফকে অপর্যাপ্ত অস্ত্র ও সীমিত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও পরীক্ষামূলকভাবে নিয়োগ করা হয়। তা সত্ত্বেও লক্ষণীয়ভাবে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।

শুধু পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে নয়, পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তেও পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে দুই দেশের সেনাসমাবেশের কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ তাদের অভ্যন্তরীণ স্মারকে বিরাজমান পরিস্থিতিকে লিপিবদ্ধ করে এভাবে।

‘কয়েক সপ্তাহ ধরে পূর্ব পাকিস্তান-ভারত সীমান্তজুড়ে মর্টার বর্ষণ ও হালকা অস্ত্রশস্ত্রের গুলিবিনিময় চলে আসছে। এই এলাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভারতীয় বাহিনী উচ্চ সতর্কতাবস্থায় রয়েছে এবং সীমান্ত অঞ্চলে পরিস্থিতি খুব উদ্বেগপূর্ণ মনে হচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইঙ্গিত দেয় যে ভারত পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তে সামরিক প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। যেমন সম্ভাব্য যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর কাছে যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে এবং সম্ভবত অগ্রবর্তী এলাকাগুলোতে অতিরিক্ত সেনার ও আর্মারের গতিবিধি দেখা যাচ্ছে। সীমান্ত বরাবর অগ্রবর্তী অবস্থানে পাকিস্তানও তাদের সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করছে বলে জানা গেছে।’