দুঃসময়ে খবর নেই, ভোটের সময় বারবার আসেন

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট গ্রহণ করা হবে বুধবার। নানা ভাবনা ভোটারদের মনে। অনেকেই ভোট দিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন; কেউ বলছেন, যাবেন না। কারও মধ্যে আবার সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে।

নির্বাচনী সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার পর গোপন কক্ষ তৈরি, কম্পিউটার স্থাপনসহ নানা কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তারা। বিকেল ৪টায় এনায়েত বাজার এলাকায় অবস্থিত মহিলা কলেজ কেন্দ্রে। ২৬ জানুয়ারি, চট্টগ্রাম
ছবি: সৌরভ দাশ

‘করোনা মহামারির সময় সন্তানদের নিয়ে খুব কষ্টে ছিলাম। কারও কাছ থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাইনি। এমন দুঃসময়ে যদি আমাদের খোঁজখবর না রাখে, তাহলে কখন রাখবে?  কিন্তু ভোটের সময় প্রার্থীরা ঠিকই বারবার এসে খোঁজ নেন। ভোট চলে গেলে তো আর কারও খবর থাকে না।’

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে ভাবনা জানতে চাইলে এভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নগরের হামজারবাগ এলাকার বাসিন্দা নূর নাহার বেগম। তিনি গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। আজ মঙ্গলবার সকালে তাঁর সঙ্গে কথা হয়।

তাহলে কি ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন না, এই প্রশ্নের জবাবে নূর নাহার বেগম বলেন, ‘যাব না কেন? অবশ্যই যাব। বিপদের সময় আমাদের খোঁজ নেননি, তাতে কী? এরপরও প্রার্থীদের মধ্যে যাঁরা এলাকার জন্য কাজ করেছেন, সামনে করবেন, তাঁদের ভোট দেওয়ার চিন্তা আছে। আর ভোট আমার অধিকার।’

কয়েক দিন আগেও নির্বাচনী পরিবেশ ভালো ছিল না। এখন মোটামুটি শান্ত। যদি কোনো বাধা না থাকে, তাহলে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা আছে।
–কবির আহমেদ, ভোটার

রাগ–ক্ষোভের পরও নূর নাহার ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিলেও নগরের এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের ভোটার স্বদেশ বড়ুয়ার চিন্তা অন্য রকম। নগরের কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা স্বদেশ আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোট নিয়ে খুব একটা ভাবনা নেই। আমরা ব্যবসা–বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত। আপাতত ভোট দিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। পরিবারের সদস্যদেরও তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কেননা, ভোট দিতে গেলেও যা হবে, না দিতে গেলেও তা হবে।’ কী হবে তা আর পরিষ্কার করেননি তিনি।

একই ওয়ার্ডের বাটালি সড়কের বাসিন্দা ৭৪ বছর বয়সী কবির আহমেদ ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেন, কয়েক দিন আগেও নির্বাচনী পরিবেশ ভালো ছিল না। এখন মোটামুটি শান্ত। যদি কোনো বাধা না থাকে তাহলে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা আছে। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। এরপরও যদি ভোট দিতে পারেন, তাহলে কাউন্সিলর পদে বিপদে–আপদে যাঁকে পান, তাঁকেই ভোট দেবেন। আর নগরের উন্নয়ন করতে পারবেন, এমন মেয়র প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা তাঁর।
নগরের হামজারবাগ এলাকায় পড়েছে পশ্চিম ষোলোশহর ওয়ার্ডে। কলেজ সড়ক ও বাটালি সড়ক হচ্ছে এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের এলাকা। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এই দুটি ওয়ার্ডের পরিবেশ নিয়ে প্রার্থীদের তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না। একপ্রকার শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই নির্বাচনী গণসংযোগ করেছেন প্রার্থীরা।

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ৭৩৫ কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪২৯ কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যা মোট কেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত আওয়ামী লীগ-সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ।

তবে প্রচারণার শুরুর পর থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের এলাকা নিয়ন্ত্রণ নেওয়াকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত ছিল পাঠানটুলী ওয়ার্ড। একপর্যায়ে ১২ জানুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী নজরুল ইসলাম বাহাদুর ও বিদ্রোহী প্রার্থী আবদুল কাদেরের সমর্থকদের সংঘর্ষে এক ব্যক্তি খুন হন। খুনের ঘটনায় আবদুল কাদেরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। সে খুনের রেশ ধরে সৃষ্ট হওয়ায় উত্তেজনা ভোটের প্রচারণার শেষ দিন পর্যন্ত ছিল।

ভোটের আগের দিন আজ বিকেলে এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও গলিতে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের প্রচুর পোস্টার। তবে কাদেরের তেমন কোনো পোস্টার দেখা যায়নি।

ওয়ার্ডের মতিয়ার পুল এলাকায় পান–সিগারেটের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল জলিল ও মোহাম্মদ সুমন। তাঁরা বলেন, এলাকার অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখন দরকার সমাজকে ঠিক রাখা। আর দুঃশাসন দূর করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। যেসব প্রার্থী এসব ব্যাপারে যোগ্য তাঁদেরই ভোট দেওয়ার ইচ্ছা আছে।

বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটগ্রহণের সরঞ্জাম পাঠানোর ব্যস্ততা নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। চট্টগ্রাম, ২৬ জানুয়ারি
ছবি: সৌরভ দাশ

তবে গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কেন্দ্রে গিয়েও ভোট দিতে না পারার আফসোস রয়ে গেছে আবদুল জলিলের। তিনি বলেন, এই রকম পরিস্থিতি আশা করি এবার হবে না।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে নগরের লালখান বাজার ওয়ার্ড। অনেক দিন ধরে এলাকার আধিপত্য নিয়ে এই ওয়ার্ডে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। নির্বাচনী প্রচারণার পরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইতিমধ্যে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে।

এ ছাড়া ভেতরে–ভেতরে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে এলাকায়। তার প্রমাণ পাওয়া যায় নগরের মতিঝরনা এলাকায় এক ভোটারের সঙ্গে কথা বলার সময়। এলাকার পরিস্থিতি তিনি বলছিলেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদককে। কিন্তু পাশ থেকে আরেকজন লোক এসে তাঁকে টেনে নিয়ে যান। যাওয়ার সময় বলেন, ‘কেন শুধু শুধু গরিব মানুষদের বিপদে ফেলছেন? এলাকার পরিস্থিতি কী তা সবাই জানে।’

লালখান বাজার ওয়ার্ডের মতিঝরনা এলাকার একটি ও চানমারি সড়কের একটি ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, এই দুটি ভোটকেন্দ্রের সামনে মঙ্গলবার বিকেল থেকে কিছু লোক জড়ো হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন। গলির প্রবেশমুখগুলোতেও দল বেঁধে কিশোর–তরুণদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে।

আপাতত ভোট দিতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। পরিবারের সদস্যদেরও তেমন কোনো আগ্রহ নেই। কেননা, ভোট দিতে গেলেও যা হবে, না দিতে গেলেও তা হবে।
–স্বদেশ বড়ুয়া, ভোটার

এই ওয়ার্ডের চানমারি এলাকার নারী ভোটার হোসনে আরা বলেন, ‘বাবা এলাকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। কখন কী হয় তা নিয়ে খুব চিন্তিত। তারপরও ভোট দিতে যাব।’

তাঁর প্রত্যাশা, যে প্রার্থীই নির্বাচিত হোক, তিনি যেন এলাকার কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করেন। আর এলাকার অশান্তি দূর করেন। মানুষ যেন একটু শান্তিতে থাকতে পারেন।

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ৭৩৫ কেন্দ্রে। এর মধ্যে ৪২৯ কেন্দ্রকে গুরুত্বপূর্ণ (ঝুঁকিপূর্ণ) হিসেবে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যা মোট কেন্দ্রের ৫৮ শতাংশ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মূলত আওয়ামী লীগ–সমর্থিত কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের দ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ।