দুই গুণী পেলেন ভারতের ‘পদ্মশ্রী’

সন্‌জীদা খাতুন
ফাইল ছবি

ভারতের মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক সম্মাননা ‘পদ্মশ্রী’-তে ভূষিত হলেন বাংলাদেশের দুজন বিশিষ্ট গুণী অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক।  ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোমবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।

এ বছর ভারত সরকার ১১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে সাতজন পেয়েছেন পদ্মবিভূষণ, ১০ জন পেয়েছেন পদ্মভূষণ আর ১০২ জনকে দেওয়া হয়েছে পদ্মশ্রী সম্মাননা। এর আগে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও কূটনীতিবিদ সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ‘পদ্মভূষণ’ সম্মাননা পেয়েছিলেন।  আর ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননা পেয়েছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ এনামুল হক এবং সমাজকর্মী ঝর্ণাধারা চৌধুরী।

২.
সন্‌জীদা খাতুন বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক, বাঙালি সংস্কৃতির বিরল সাধক। কাজী মোতাহার হোসেন ও সাজেদা খাতুনের কন্যা সন্‌জীদা খাতুন ঐতিহ্যবাহী পরিবারের পরম্পরাই শুধু রক্ষা করেননি, নিজেই সৃষ্টি করেছেন নতুন ঐতিহ্যধারা। বায়ান্নর ভাষার মিছিল থেকে আজ অবধি তিনি প্রগতি–সরণির অনলস অভিযাত্রী। একুশ তাঁকে ‘ভাষা দিয়েছে’, গত শতকের ষাটের দশকজুড়ে বুদ্ধিবৃত্তিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন তাঁকে শাণিত করেছে আর একাত্তর তাঁকে মুখোমুখি লড়াই করে জিততে শিখিয়েছে। এই ভূখণ্ডের বাংলা ও বাঙালিবিরোধী পাকিস্তানি কালপর্বে ‘সন্‌জীদা খাতুন’ এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহের নাম।

সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ছায়ানট’ গড়ে ওঠে সন্‌জীদা খাতুন ও তাঁর সহযোদ্ধাদের সংগ্রামদীপ্ত শ্রম, মেধা ও অঙ্গীকারে। বিরুদ্ধ সময়ে, অসম সাহসে পয়লা বৈশাখে রমনার বটমূলে বাংলা বর্ষবরণ, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনসহ বাঙালি সংস্কৃতি বিকাশ-প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাংস্কৃতিক ভূমি তৈরিতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল তাঁর। তিনিই তো সেই সন্‌জীদা খাতুন, পঞ্চাশের দশকে কার্জন হলে এক অনুষ্ঠানে যাঁকে বঙ্গবন্ধু গাইতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’, যা পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি লাভ করে।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে, মহান মার্চে রংপুর থেকে প্রথমে ঢাকায়, পরে সাভারের জিরাব গ্রাম থেকে আবার ঢাকা হয়ে কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ভারতের আগরতলা রাজ্যে পৌঁছালেন সন্‌জীদা খাতুন ও তাঁর সাংস্কৃতিক সহযোদ্ধারা। সেখানে কিছুদিন থেকে ৫ মে ১৯৭১ কলকাতায় প্রবেশ করে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রবাসে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। স্বাধীনতার পর ‘ছায়ানট’, ‘রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ’, ‘কণ্ঠশীলন’, ‘ব্রতচারী আন্দোলন’ কিংবা ‘নালন্দা’র মতো বহুমুখী শিক্ষা-সংস্কৃতিগত সামষ্টিক তৎপরতায় সুযোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক-সাম্যবাদী-আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে পলি সঞ্চার করে যাচ্ছেন তিনি। তাঁর সমুখেই রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বোমার আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে, তবু তিনি একলা চলার অভীক হয়ে বলেছেন, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম চলবেই।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সন্‌জীদা খাতুন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্রী; এই বিদ্যায়তন থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি এবং ‘দেশিকোত্তম’ সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি একজন গুণী রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী, রবীন্দ্র-নজরুল-সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের জীবন-সৃষ্টির বিচিত্র দিক নিয়ে স্মরণীয় কিছু বইয়ের রচয়িতা সন্‌জীদা সমাজ-সংস্কৃতি নিয়েও নিয়মিত লিখে চলেছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সন্‌জীদা খাতুনের সম্প্রতি প্রকাশিত দুটো স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ শান্তিনিকেতনের দিনগুলি এবং জীবনবৃত্ত।
সন্‌জীদা খাতুন পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত হওয়ায় সোমবার রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছায়ানট বলেছে, এই অর্জন সমগ্র বাঙালির এবং বাংলাদেশের মানুষের।

সাজ্জাদ আলী জহির
ফাইল ছবি

৩.
লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাজ্জাদ আলী জহির ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালে কাকুল সামরিক একাডেমিতে সিনিয়র ক্যাডেট হিসেবে প্রশিক্ষণরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আগস্টের শেষে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে এসে যুদ্ধে যোগ দেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে আর্টিলারি ব্যাটারি পরিচালনায় দক্ষতার জন্য ‘বীর প্রতীক’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি। স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে ‘লেফটেন্যান্ট কর্নেল’ পদে উন্নীত হয়ে অবসরে যান। তিনি একজন গুণী মুক্তিযুদ্ধ গবেষকও। পাঁচজন বীরশ্রেষ্ঠের জীবনীসহ তিনি লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের চিত্র কাহিনী, রংপুর সেনানিবাসে দুঃসাহসিক আক্রমণ, মুক্তির সংগ্রামে মেহেরপুর, মুক্তির সংগ্রামে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস: সিলেট-এর মতো অনুসন্ধানী বই। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বইয়ের সংখ্যা ৫৪।

সাজ্জাদ আলী জহির সোমবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত আমাকে যে সম্মাননা দিয়েছে, সে জন্য দেশটির সরকার ও ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। জীবনের বাকি দিনগুলো চেষ্টা করব মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখা, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করা, বই লিখে যাওয়া এবং নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত করতে।’