দুই ডজন তদন্ত কমিটি, সুপারিশ বাস্তবায়ন নেই

দুই দশকে আগুন লেগেছে প্রায় ২৪ বার। পুড়েছে অন্তত ৮২ একর বনভূমির গাছপালা।

শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভারানী এলাকায় সুন্দরবনে আগুন লাগে
ফাইল ছবি

প্রায় প্রতিবছরই আগুনে পুড়ছে সুন্দরবন। গেল দুই দশকে এ বনে অন্তত ২৪ বার আগুন লেগেছে। এতে পুড়ে গেছে বনের কিছু অংশের গাছপালা। সর্বশেষ গত সোমবার লাগা আগুনে পুড়ে গেছে প্রায় আড়াই একর বনভূমি। আগুন লাগার পর প্রতিবারই ঘটনা তদন্তে করা হয়েছে কমিটি। সেসব কমিটি আগুন লাগার কারণ তুলে ধরে তা বন্ধে কী কী করতে হবে, তার তালিকাও দিয়েছে। তবে দীর্ঘদিনেও সেসব সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।

বন বিভাগের তদন্ত কমিটিগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমবারের আগের ২৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সুন্দরবনের অন্তত ৮২ একর বনভূমির নানা গাছ, গুল্ম-লতা পুড়ে যায়। ওই সব অগ্নিকাণ্ডের কারণ হিসেবে মাছ শিকারের জন্য আগুন দেওয়া, নাশকতা, অসচেতনতা ও অবহেলায় ফেলে দেওয়া বিড়ি বা সিগারেটের আগুনকে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে সুন্দরবনকে সুরক্ষা দিতে বন ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি লোকালয়–সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় বেড়া, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ এবং বনসংলগ্ন মরে যাওয়া নদী-খাল খননের সুপারিশ করা হয়েছিল। তবে এসব সুপারিশের কোনোটিই এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

# মাছ ধরার জন্য জায়গা তৈরি করাই আগুন দেওয়ার অন্যতম কারণ।
# আগুন নেভাতে প্রশিক্ষিত জনবল ও যন্ত্রপাতি বন বিভাগের নেই।

সুন্দরবনের চাঁদপাই ও শরণখোলা রেঞ্জ নিয়ে ২০০১ সালে গঠিত হয় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। তাদের নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ২০০৬ ও ২০১৬ সালে। এ দুই বছরেই সুন্দরবনে ৯ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। এতে পুড়ে যায় প্রায় ১৭ একর বনভূমি। এ ছাড়া ২০০২ সাল থেকে অধিকাংশ বছরেই এক বা একাধিকবার আগুন লেগেছে।

সুন্দরবনের সব কটি আগুনের ঘটনাই শুষ্ক মৌসুমে। এর মধ্যে ২১ বার আগুন লেগেছে মার্চ, এপ্রিল ও মে—এ তিন মাসে। আর ২৪টি অগ্নিকাণ্ডের অধিকাংশই ঘটেছে বনের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায়। এর সংলগ্ন লোকালয় হলো বাগেরহাটের শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ ও মোংলা উপজেলা। সেখানকার স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আগুন দেওয়ার অন্যতম কারণ মাছ ধরা। বনের এ অঞ্চল অপেক্ষাকৃত উঁচু। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে সেভাবে পানি প্লাবিত হয় না। এ মৌসুমে আগুন দেওয়ার ফলে বনের মধ্যে পড়ে থাকা পাতা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একই সঙ্গে গাছের গোড়া পুড়ে গর্ত তৈরি হয়। বর্ষায় পানিতে ভরে গেলে সেখানে প্রচুর মাগুর, শিং, গজার, শোল ও কৈ মাছ পাওয়া যায়। স্থানীয় অন্তত ৩২ জন এই কথা বলেন।

প্রতিবারই আগুন লাগার পর নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে এগিয়ে আসেন আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা। তাঁরা বলছেন, বছর বছর একটি চক্র এখানে আগুন লাগায়। প্রভাবশালী এ চক্র এ প্রক্রিয়ায় লাখ লাখ টাকার মাছ ধরে বিক্রি করে। উপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় তারা এ ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। বনসংলগ্ন সোনাতলা গ্রামের মো. ফিরোজ হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মৌয়াল বা বনজীবীরা কখনোই বনে আগুন দেয় না। বনে মাছ ধরে আমাদের জীবন চলে। ঝড়–ঝঞ্ঝায় এই বন বাঁচায় রাখে, এখান থেকেই খাবার আসে। আগুন লাগলে সবচেয়ে ক্ষতি হয় আমাদের। বিভিন্ন সময় বনে পাস-পারমিট (প্রবেশ অনুমতি) বন্ধ করে দেয়। তখন না খেয়ে মরা লাগে আমাদের। কিন্তু যারা আগুন দেয়, তাদের সেভাবে কিছু হয় না।’

সুন্দরবনে অন্তত চারটি অগ্নিকাণ্ডে বন বিভাগ গঠিত তদন্ত কমিটির অন্যতম একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, আগুনের মতো ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়ার মতো প্রশিক্ষিত জনবল ও যন্ত্রপাতি বন বিভাগের নেই। আগুন লাগার পর লোকালয়ের ফায়ার স্টেশন থেকে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই দেখা যায়, আগুন অনেকটা ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত পানি দেওয়ার মতো ব্যবস্থা করা গেলে আগুন বাড়তে পারে না।

বন বিভাগকে সহায়তার জন্য গঠিত স্বেচ্ছাসেবী দল কমিউনিটি পেট্রোলিং গ্রুপ বা সিপিসির ভোলা দলের সভাপতি খলিল জমাদ্দারও বলেন, বনের মধ্যে নদী–খালগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় আগুন লাগলে নেভাতে বেগ পেতে হয়।

সুন্দরবনকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের মানুষের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ অভিহিত করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বাগেরহাট জেলা কমিটির সদস্যসচিব মো. নূর আলম শেখ বলেন, প্রায় প্রতিবছর শুষ্ক মৌসুম এলে সুন্দরবনে আগুন লাগার খবর আসে। বারবার আগুনে বনের পরিবেশ-প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের পেছনে অসাধু মাছশিকারি এমনকি বন বিভাগের অসাধু ব্যক্তিদের নামও এসেছে বিভিন্ন সময়। তাঁদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পাশাপাশি বনসংলগ্ন এলাকার মানুষকে আরও সচেতন করতে হবে।

সেভ দ্য সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনকে আগুন থেকে রক্ষার জন্য লোকালয়সংলগ্ন নদী-খাল খনন, কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া এবং নিরাপত্তাচৌকির মাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া বনে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধে বনরক্ষীদের তৎপরতাও বাড়াতে হবে।