দুই দেশের বোঝাপড়াকে দুর্বল করবে

পেঁয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা

  • বিভিন্ন সীমান্তে আটকে থাকা কয়েক শ পেঁয়াজবাহী ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতির অপেক্ষায়।

  • পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের ইঙ্গিত।

ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্তের প্রভাবে বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। অপেক্ষাকৃত সুলভ মূল্যে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় এই পণ্য কিনতে টিসিবির ট্রাকে নগরবাসীর ভিড়। গতকাল সকালে রাজধানীর তোপখানা রোডে
ছবি: হাসান রাজা

পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের রপ্তানি বন্ধ না করতে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ। রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলেও তা আগেই জানানোর অনুরোধও ছিল। তাই ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের আকস্মিক ঘোষণা দুই বন্ধুপ্রতিম দেশের ২০১৯ ও ২০২০ সালের আলোচনা ও বোঝাপড়ার ভিত্তিকে দুর্বল করবে।

পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের পর এমন উদ্বেগ জানিয়ে গতকাল বুধবার ভারতকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গতকাল দুপুরে প্রথম আলোর কাছে চিঠির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। চিঠিতে দুই নিকট প্রতিবেশীর চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে পেঁয়াজ রপ্তানি আবার শুরু করতে ভারতকে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় গত সোমবার পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর গত দুদিনে পেঁয়াজের (ভারতীয়) দাম ৫৫ থেকে বেড়ে ৭০ টাকায় ঠেকেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার খোলাবাজারে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে।

পেঁয়াজের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের হঠাৎ সিদ্ধান্তটি রাজনৈতিক কি না বা এর পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘ভারত কখন বন্ধ করে দেবে, এটা আন্দাজ করা মুশকিল। তবে রাজনীতির চেয়ে আমি বাণিজ্যটা বুঝি। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ভারতে নোট ভারবাল (কূটনৈতিক পত্র) পাঠিয়েছে।’

ঢাকা ও দিল্লির যোগাযোগ

ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সোমবার দুপুরের পর থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ শুরু হয়। দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ককে বিবেচনায় নিয়ে বিষয়টি সুরাহার অনুরোধ জানায় বাংলাদেশ। বিশেষ করে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না গেলেও পেঁয়াজ আমদানির জন্য এর মধ্যেই যেসব ঋণপত্র (এলসি) খোলা হয়ে গেছে, তা ছাড়ের অনুরোধ জানানো হয়। বিভিন্ন সীমান্তে আটকে থাকা কয়েক শ পেঁয়াজবাহী ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো আভাস দিয়েছে, এখনই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেবে কি না, স্পষ্ট নয়। তবে এর মধ্যে এলসি অনুযায়ী পেঁয়াজ পাঠানো হতে পারে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে জানান, গতকাল সকালে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের কাছে একটি কূটনৈতিক চিঠি পাঠানো হয়। এতে বলা হয়েছে, ১৪ সেপ্টেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের বিষয়ে ভারত সরকারের আকস্মিক ঘোষণা বাংলাদেশকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, এতে করে বাংলাদেশের বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহে সরাসরি প্রভাব পড়বে।

এ বছরের ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি দুই দেশের বাণিজ্যসচিবদের বৈঠকে বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী রপ্তানি বন্ধ না করার জন্য ভারতকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। যদি কোনো কারণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেই হয়, তবে তা যেন বাংলাদেশকে আগেভাগে জানানো হয়—বাণিজ্যসচিবদের বৈঠকে ভারতকে সেই অনুরোধও করা হয়েছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের অক্টোবরে ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরে প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। তখনো বাংলাদেশ অনুরোধ জানিয়েছিল, এমন কিছু ঘটলে যাতে আগাম জানানো হয়।

দেশি পেঁয়াজের উৎপাদন বেশি

দেশে বর্তমানে পাঁচ লাখ টন পেঁয়াজ মজুত রয়েছে এবং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন দেশ থেকে আরও পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

তুরস্ক ও মিসর থেকে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে জানিয়ে টিপু মুনশি বলেন, অল্প দিনের মধ্যে এগুলো দেশে পৌঁছাবে। টিসিবি এবার পেঁয়াজের বড় ধরনের মজুত গড়ে তোলার পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। পেঁয়াজ সরবরাহে কোনো ঘাটতি হবে না।

পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার অনুরোধ বাংলাদেশের। দুই দিন ধরে দিল্লির সঙ্গে আলোচনা চলছে।

পেঁয়াজ রপ্তানি না করার ভারত সরকারের সিদ্ধান্তের সুযোগ নিয়েছে দেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী—এ কথা উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, গত বছরের তুলনায় দেশে এবার প্রায় এক লাখ টন পেঁয়াজ বেশি উৎপাদিত হয়েছে। আগে থেকেই পেঁয়াজের আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতি নজর রাখা হচ্ছিল। সে কারণে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয় এবং ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে তা ৩০ টাকা মূল্যে দেশব্যাপী খোলাবাজারে বিক্রি শুরু করা হয়। আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত এ কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

আমদানি শুল্ক থাকছে না!

গতকাল সচিবালয়ে পেঁয়াজ আমদানির শুল্ক নিয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। তিনি জানান, পেঁয়াজ আমদানিতে বিদ্যমান ৫ শতাংশ শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তা আমরা চাই না। তাই পেঁয়াজের ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়টি বিবেচনা করব।’

নিত্যপণ্য থেকে সরকারের শুল্ক আদায় করার কোনো উদ্দেশ্য নেই জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, আমদানি শুল্কের কারণে কোনো পণ্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণত মন্ত্রণালয়কে দায়ী করা হয়। অর্থমন্ত্রী এবার আর সেই দায় নিতে চান না।