দুটি গাড়িই অবৈধভাবে চলছিল রাস্তায়

■ পিকআপের রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও ট্যাক্স টোকেন মেয়াদোত্তীর্ণ। জিপের কোনো কাগজপত্রই নেই, নম্বরও ভুয়া।

■ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে চকরিয়ায় পিকআপ ভ্যানের চাপায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু হয়।

■ চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের ফটিকছড়িতে ট্রাফিক পুলিশের ধাওয়া খেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জিপের চাপায় দুই স্কুলছাত্রী নিহত হয়।

প্রতীকী ছবি

কক্সবাজারের চকরিয়ায় মালুমঘাটে পাঁচ ভাইকে চাপা দেওয়া পিকআপ ভ্যানের রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ও ট্যাক্স টোকেনের কোনোটিরই মেয়াদ ছিল না। আবার চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ট্রাফিক পুলিশের ধাওয়ার মুখে দুই ছাত্রীকে চাপা দেওয়া জিপটির (চাঁদের গাড়ি) রাস্তায় চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এসব কাগজপত্রই নেই। গাড়িতে যে নম্বর দেওয়া ছিল, তা-ও ‘ভুয়া’। চালকেরও লাইসেন্স নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কাগজপত্র ঠিক না থাকার পরও এসব গাড়ি কীভাবে রাস্তায় চলছে?—এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের মহাসচিব মঞ্জুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, জিপসহ অনেক গাড়িরই কাগজপত্র ঠিক নেই। চালকদের লাইসেন্স নেই। এগুলো রাস্তায় চলার কথা নয়। কিন্তু এরপরও পুলিশকে চাঁদা দিয়ে ঠিকই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। শহর এলাকায় মোটামুটি তদারকি থাকায় দুর্ঘটনার সংখ্যা কম। কিন্তু জেলা পর্যায়ে এসব নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। এতে সেখানে বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে।

গত মঙ্গলবার ভোরে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পিকআপ ভ্যানের চাপায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই ভাই ও এক বোন। স্থানীয় একটি মন্দির থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তাঁরা।

গত বুধবার দুপুরে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি মহাসড়কের ফটিকছড়ি উপজেলার ফেলাগাজী দীঘি এলাকায় ট্রাফিক পুলিশের ধাওয়া খেয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জিপের চাপায় দুই স্কুলছাত্রী নিহত হয়। তারা দুজনই হাইদচকিয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের এবারের এসএসসি পরীক্ষার্থী। ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা বিক্ষোভ করেছিলেন। সড়ক অবরোধ করে আগুন দেন ট্রাফিক পুলিশের মোটরসাইকেলে।

জিপের নম্বরই ‘ভুয়া’

হাইওয়ে পুলিশ জানায়, ছাত্রীদের মেরে ফেলা ওই জিপচালকের কোনো লাইসেন্স ছিল না। গাড়িটির নম্বর ভুয়া। ফিটনেস, ট্যাক্স টোকেন, রোড পারমিট কিছুই ছিল না। বিআরটিএর এক কর্মকর্তাও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এসব গাড়ির চালকদের দাবি, তাঁরা ‘চাঁদা’ দিয়ে সড়কে গাড়ি নামানোর অনুমতি পান পুলিশের কাছ থেকে।

গত বুধ ও বৃহস্পতিবার উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং চালক, গাড়ির মালিক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ১০ থেকে ১৫টি স্থানে প্রতিদিন তল্লাশিচৌকি বসানো হয়।

চালক, মালিক ও জনপ্রতিনিধিদের ভাষ্য, তল্লাশিচৌকির নামে এসব স্থানে মূলত ‘টাকা তোলা’ হয়। মোটরসাইকেল, অটোরিকশা, ট্রাক, জিপসহ সব ধরনের যান্ত্রিক যানবাহনের প্রতিটি থেকে ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করে এসব পুলিশ।

এ প্রসঙ্গে পাইন্দং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সরোয়ার হোসেন প্রথমে আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ মোড়ে মোড়ে তল্লাশির নামে বেপরোয়া চাঁদাবাজি করে। এই চাঁদার পরিমাণ মাসে ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা। এসব বন্ধ করতে উপজেলা প্রশাসনের সমন্বয় সভায় দাবি জানানো হলেও চাঁদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না বলেও দাবি তাঁর।

ফটিকছড়ির নাজিরহাট জিপ মালিক সমিতির সভাপতি মুহাম্মদ আবু তৈয়ব বলেন, তাঁর সমিতিতে ২৫টি জিপ আছে। পুলিশ সড়কে তল্লাশিচৌকির নামে তাঁদের চলাচলকারী গাড়িগুলো থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায় করেন।

জিপচালক মুহাম্মদ নজরুল ইসলামও জানান, তাঁরা বছরে ৪ হাজার ৩০ টাকা দিয়ে এক বছরের জন্য টোকেন নেন পুলিশ থেকে। চাঁদা না দিলে গাড়ি আটকে মামলা দিয়ে হয়রানি করেন।

এ প্রসঙ্গে জেলা পুলিশের হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ রকম অভিযোগসহ ১০ দফা দাবি দিয়ে আমাদের জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। বিষয়টি প্রমাণিত হলে তদন্ত করে চাঁদাবাজ যে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পিকআপের কাগজের মেয়াদই নেই

চকরিয়ার মালুমঘাটে পাঁচ ভাইকে চাপা দেওয়া পিকআপ ভ্যানটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-ফিটনেস সনদ, রুট পারমিট ও ট্যাক্স টোকেন কোনো কিছুরই মেয়াদ নেই। আর চালকের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। দুর্ঘটনার পর থেকে চালক পলাতক।

বিআরটিএ, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, মালুমঘাটের দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পিকআপ ভ্যানটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালের ১২ মে। ট্যাক্স টোকেনেরও মেয়াদ শেষ হয় সাড়ে তিন বছর আগে। আর রুট পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়েছে আড়াই বছর আগে, ২০১৯ সালের ২৮ মে।

অর্থাৎ প্রায় আড়াই থেকে সাড়ে তিন বছর ধরে এই পিকআপ ভ্যানটি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হালনাগাদ না করেই রাস্তায় চলাচল করছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআরটিএর চট্টগ্রামের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, পিকআপ ভ্যানটির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় এটির নিবন্ধন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে।

চাঁদা নিয়ে কাগজপত্রবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচলের সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মালুমঘাট হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেফায়েত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই বিষয়ে বলার কিছু নেই। ভিত্তিহীন অভিযোগ। হাইওয়ে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিচ্ছে।

তবে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী পিকআপ ভ্যানের কাগজপত্রের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে বলে জানান ওসি শেফায়েত হোসেন। তিনি বলেন, গাড়িটির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যের জন্য বিআরটিএকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। এখন পর্যন্ত গাড়িচালকের পরিচয় চিহ্নিত ও আটক করা সম্ভব হয়নি।

সেই টিআই বরখাস্ত

জিপের চাপায় দুই ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) নিখিল জীবন চাকমাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একই ঘটনার জন্য সার্জেন্ট আল আমিনকে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করে জেলা পুলিশ লাইনে পাঠানো হয়েছে।

ফটিকছড়ি থানার ওসি মুহাম্মদ রবিউল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্রী মিশু আক্তারের চাচা মোহাম্মদ আইয়ুব বাদী হয়ে মামলা করেছেন। মামলায় গাড়িচালককে আসামি করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি বলে জানায় পুলিশ।