দুটি সংকেত অমান্য করেন তূর্ণা নিশীথার চালক

ট্রেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শাহিদা আক্তার সুমিকে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় আদর করছেন তার খালা। গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন
ট্রেন দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত শাহিদা আক্তার সুমিকে দেখে ফিরে যাওয়ার সময় আদর করছেন তার খালা। গতকাল পঙ্গু হাসপাতালে। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার আগে তূর্ণা নিশীথার লোকোমাস্টার (চালক) একটি নয়, দুটি সংকেত অমান্য করেন। দুর্ঘটনার আগে চারটি সংকেতই তূর্ণার জন্য বিপজ্জনক ছিল। ট্রেন দুর্ঘটনায় আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।

রেল মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল বুধবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ ছাড়া ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে গঠিত আরেকটি তদন্ত কমিটি গতকাল রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামের সিআরবিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেয়।

জানতে চাইলে রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. শামছুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একটি রেলস্টেশনে মোট চারটি সংকেত থাকে। আউটার, হোম, স্টার্টার, এডভান্স স্টার্টার। তূর্ণার চালক আউটার ও হোম দুটি সংকেত অমান্য করেছেন। এ কারণে দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন আজ হাতে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

গত সোমবার রাত পৌনে তিনটার দিকে মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের আউটারে (বহিঃ অংশে) চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী আন্তনগর তূর্ণা নিশীথা এবং সিলেট থেকে ছেড়ে আসা চট্টগ্রামগামী উদয়ন এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হয়। উদয়নের মাঝামাঝি তিনটি বগিতে সজোরে ঢুকে যায় তূর্ণা নিশীথা। এতে ১৬ জন যাত্রীর প্রাণহানি ঘটে এবং শতাধিক যাত্রী আহত হন। এ ঘটনায় রেল মন্ত্রণালয়, রেল ভবন ও বিভাগীয় রেলওয়ে কার্যালয় চারটি এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের একটিসহ মোট পাঁচটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

তূর্ণা নিশীথা ও উদয়ন এক্সপ্রেসের চালক ও গার্ড এবং মন্দবাগ ও কসবা স্টেশনমাস্টারসহ দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান কার্যালয়ে সাক্ষ্য দেন। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকেল পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়া হয়।

তদন্ত সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ সাক্ষী তূর্ণার লোকোমাস্টার (চালক) ও সহকারী লোকোমাস্টারকে দায়ী করেছেন। তবে চালক তাসের উদ্দিন, সহকারী চালক অপু দে ও গার্ড আবদুর রহমান ঘন কুয়াশায় সংকেত দেখেননি বলে দাবি করেছেন তদন্ত কমিটির কাছে। মন্দবাগ স্টেশনের সামনে ও পেছনে সংকেত না দেখার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত দল। এ ছাড়া চালক যদি ভুল করেন, তাহলে গার্ড কেন ভ্যাকুয়াম চাপ দেননি। ভ্যাকুয়াম চেপে (প্রেস করা) ট্রেন থামাতে পারতেন গার্ড।

>ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মন্দবাগ স্টেশনের সামনে ও পেছনের সংকেত না দেখার কারণ খুঁজে পাচ্ছে না তদন্ত দল


তদন্ত সূত্র আরও জানায়, দুর্ঘটনার সময় ঘন কুয়াশা পড়ার বিষয়টি সঠিক নয় বলে তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেছেন মন্দবাগ স্টেশনমাস্টার জাকির হোসেন। তিনি তদন্ত কমিটিকে বলেছেন, তূর্ণার চালক সংকেত অমান্য করে ট্রেন চালানোর সময় দুর্ঘটনা ঘটে।

তদন্ত কমিটির নেতৃত্ব দেন পূর্বাঞ্চলের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম। চার সদস্যের এই তদন্ত কমিটিতে আছেন পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী, প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী ও প্রধান সংকেত কর্মকর্তা।

তদন্ত কমিটির প্রধান নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চালক, গার্ডসহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ঘটনার সময় কার কী ভূমিকা ছিল, তা জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।

তদন্ত কমিটির দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন
রেল মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি গতকাল বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আইন ও ভূমি) মো. রফিকুল ইসলাম এই কমিটির প্রধান। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন বাংলাদেশ রেলওয়ের প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, রেলওয়ের যুগ্ম মহাপরিচালক (অপারেশন) রাশেদা সুলতানা, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (প্রশাসন) আলমগীর হোসেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান রফিকুল ইসলাম বলেন, আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। যাঁদের গাফিলতিতে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। সিগন্যাল প্যানেল বোর্ড, ঘটনাস্থলের বিভিন্ন আলামত ও প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।

দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা
ট্রেন দুর্ঘটনায় মন্দবাগ রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মো. জাকের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে গত মঙ্গলবার রাত ১০টায় আখাউড়া রেলওয়ে থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। মামলাটি তদন্ত করতে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলওয়ে থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. আনোয়ার হোসেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, তূর্ণা নিশীথা ট্রেন ও উদয়ন এক্সপ্রেস ট্রেন মন্দবাগ স্টেশনে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। এখানে উদয়ন এক্সপ্রেসকে এক নম্বর লাইনে নেওয়া হয়। তূর্ণা নিশীথাকে পাস দেওয়া হয়। তূর্ণা নিশীথা ট্রেন অনলাইন এবং সিগন্যালবিহীন অতিক্রম করে। এতে প্রধান লাইন ব্লক হয়। লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কিছু লোক মারা যায়।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, বুধবার সকাল থেকে তিনি ঘটনাস্থলে রয়েছেন। প্রাথমিক তদন্ত শুরু করেছেন।

তূর্ণার চালককে রক্ষার চেষ্টা
তূর্ণার লোকোমাস্টার ও সহকারী লোকোমাস্টারকে রক্ষা করতে নেমেছেন রেলওয়ে লোকো রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী। তূর্ণার লোকোমাস্টারকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হচ্ছে বলে তিনি রেলের বিভিন্ন জায়গায় বলে আসছেন।

জানতে চাইলে মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, মন্দবাগ স্টেশন এলাকায় মাটির স্তূপ রয়েছে। মাটির কারণে রাতে সিগন্যাল বাতি (সংকেত) দেখা যায় না। ওই সময় ঘন কুয়াশা ছিল।

গত ৩১ জুলাই রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক নাছির উদ্দিন আহমেদের কাছে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান বলে দাবি করেন মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিকার না নিয়ে লোকোমাস্টারের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টা করছে।

প্রসঙ্গত, লাকসাম থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ডাবল রেললাইনের কাজ চলমান রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নতুন লাইন নির্মাণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় মাটি, বালু ও পাথর স্তূপ করে রেখেছে। তবে মাটির স্তূপের জন্য সংকেত দেখা যায় না বলে যে অভিযোগ ওঠে, তা সঠিক নয় বলে রেলের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।