কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে সেলিমের

দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধে বিপাকে পড়া বাস চালকের সহকারী হৃদয়। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, ঢাকা। ১১ এপ্রিলছবি: আসাদুজ্জামান

করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণায় বদলে গেছে রাজধানীর বাস টার্মিনালগুলোর চিরচেনা রূপ। প্রায় জনশূন্য টার্মিনালগুলোয় যাত্রীদের আনাগোনা নেই। পড়ে আছে সারিবদ্ধ বাস। বাসের ভেতর বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন বাসচালক, চালকের সহকারী এবং সুপারভাইজাররা।

প্রায় ৩০ বছর ধরে বাস চালিয়ে সংসার চালিয়ে আসছেন চাঁদপুরের আমির হোসেন। তাঁর তিন ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আরেক মেয়ে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। আরেক ছেলে প্রতিবন্ধী। আরেক ছেলের বয়স মাত্র দুই বছর।

এক সপ্তাহ ধরে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। তবু বাসচালক আমির হোসেন প্রতিদিন সায়েদাবাদ টার্মিনালে আসেন। কবে বাস চলাচল শুরু হবে, সেসব খবর নেন সহকর্মীদের কাছ থেকে। তবে আবার লকডাউন শুরু হওয়ার খবর শুনে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন তিনি। কারণ, গেল বছরের তিন মাসের লকডাউনে ঘরভাড়া দিতে পারেননি। সময়মতো ভাড়ার টাকা পরিশোধ না করায় বাসা ছেড়ে দিতে হয়। এবারও একই অবস্থা। তাই কীভাবে সংসার চালাবেন, তা নিয়েই বড়ই চিন্তিত তিনি।

দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তিত বাসচালকের সহকারী সেলিম
ছবি: আসাদুজ্জামান

আমির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের লকডাউনের সময় খুব ক্রাইসিসে ছিলাম। আবার লকডাউন এসেছে। আবার বাস চলাচল বন্ধ। বাসের চাকা বন্ধ হলে আমরা কীভাবে সংসার চালাব? গত পরশু দিন বাড়িওয়ালা ভাড়া দিতে চলেছেন। এখন বাসাভাড়া কোত্থেকে দেব? স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খাওয়া তো দুষ্কর হয়ে গেছে।’

বাসের ভেতর কাটছে সময়

রোববার বেলা দুইটার সময় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল, সারিবদ্ধভাবে রাখা প্রায় প্রতিটি বাসের ভেতর রয়েছেন বাসচালক, চালকের সহকারী। বাস না চললেও বাস পাহারা দিচ্ছেন। দুই বেলা খাবারের টাকা মালিকের কাছ থেকে নিচ্ছেন। নিজেরা কোনোমতে খেয়েপরে টার্মিনালে থাকতে পারছেন। কিন্তু সংসার খরচ কীভাবে জোগাড় করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত তাঁরা।

শরীয়তপুরের মোহাম্মদ সেলিম প্রায় ২০ বছর ধরে দূরপাল্লার বাসের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করে আসছেন। দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন তিনি। গত বছরের লকডাউনে সংসার চালাতে গিয়ে ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই ঋণের পুরো টাকা এখনো শোধ দিতে পারেননি। আবার লকডাউন শুরু হওয়ায় গত বছরের কষ্টের দিনগুলোর কথা বারবার মনে পড়ছে সেলিমের।

দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চিন্তিত বাসচালক আমির হোসেন
ছবি: আসাদুজ্জামান

সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক সপ্তাহ ধরে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ। কাজ না করতে পারলে ঘরে ক্যামনে টাকা-পয়সা নিয়ে যামু। কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। এখন ঘরভাড়া কোত্থেকে দেব, ক্যামনে চাল-ডাল কিনমু, কিছুই ভাবতে পারছি না?’
১৪ এপ্রিল থেকে আবার লকডাউন শুরুর ঘোষণা আসার পর থেকে আরও বেশি হতাশ হয়ে পড়েছেন পরিবহনশ্রমিকেরা।

৩৫ বছর ধরে বাস চালিয়ে আসা ষাটোর্ধ্ব বাসচালক আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ‘গাড়ি চললে আমাদের আয়। লকডাউনে সাত দিন ধরে গাড়ি বন্ধ। আমরা খুব কষ্টে আছি। আবার লকডাউন আসছে!’

পরিবহনমালিকেরাও বিপদে

করোনায় গত বছরের লকডাউনে টানা ৬৬ দিন দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ ছিল। এতে করে আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েন বাসমালিকেরা। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটের একটি বাসের মালিক মোহাম্মদ সুজন। ব্যাংকঋণ নিয়ে তিনি বাসটি কেনেন। চলমান বিধিনিষেধে বাস থেকে আয় না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি।

সুজন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার একটাই বাস। ব্যাংক লোনের মাধ্যমে গাড়িটা কিনেছিলাম। অন্য কোনো ইনকাম সোর্স নেই। আমার মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁরা ব্যাংক লোন নিয়ে গাড়ি কিনেছেন। আমরা না পারতেছি কারও কাছ থেকে চেয়ে খাইতে, না পারতেছি কারও কাছ হাত পাততে।’

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল
ছবি: আসাদুজ্জামান

বাংলাদেশ পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘চলমান লকডাউনে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে বাসচালক, চালকের সহকারীসহ অন্যরা চরম বিপদে আছেন। অসচ্ছল সব পরিবহনশ্রমিকের আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবহন মালিককে সমিতির পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে।’