দুর্যোগে বাড়ে নারীর দুর্ভোগ, সমাধানে প্রয়োজন টেকসই পরিকল্পনা

‘দুর্যোগে নারীর বিপদাপন্নতা: অশ্রুত আখ্যান’ ওয়েবিনারে আলোচকেরা

করোনাভাইরাসের বিস্তারের পাশাপাশি বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও তা ঠেকিয়ে রাখার কোনো উপায় নেই। একইভাবে বিভিন্ন দুর্যোগে নারীর মাসিক হওয়া বন্ধ থাকে না। অন্তঃসত্ত্বা নারীকেও সময় হলে ঠিকই সন্তান প্রসব করতে হয়। তাই দুর্যোগে নারীর ভোগান্তিও বাড়ে বহুগুণ। ফলে দুর্যোগে নারীর ভোগান্তি কমাতে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।

‘দুর্যোগে নারীর বিপদাপন্নতা: অশ্রুত আখ্যান’ ওয়েবিনারে আজ বৃহস্পতিবার আলোচকেরা এ কথা বলেছেন। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সহায়তায় পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (প্রান) ও একশনএইড বাংলাদেশ এ আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চলতি বছরের ২২ জুলাই পর্যন্ত দেশে বন্যাদুর্গত ৩৩ লাখের মধ্যে নারী ছিলেন ১৭ লাখের বেশি, যা মোট দুর্গত মানুষের ৫২ শতাংশ। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ১৯ জেলায় আক্রান্ত ২৬ লাখের মধ্যে ৪৯ হাজারের বেশি অন্তঃসত্ত্বাসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রায় ৮ লাখ ২০ হাজার নারী। আর করোনাভাইরাসের বিস্তারেও নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

আলোচনায় বিভিন্ন সময় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া নারীরা জানান, কেন্দ্রগুলোতে আলোর ব্যবস্থা থাকে না। নারীদের জন্য আলাদা টয়লেট নেই। অন্তঃসত্ত্বা নারী ও সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়ান, এমন মায়েদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধী নারীরাও বিপাকে পড়েন। কিশোরীরা মাসিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে লজ্জায় থাকে। পুরুষের সঙ্গে একই ঘরে থাকতে হয় বলে যৌন হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় আশ্রয় নেওয়া নারী ও শিশুদের।

আশ্রয়কেন্দ্র নিয়ে নারীদের বিভিন্ন অভিযোগ সত্য উল্লেখ করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আতিকুল হক বলেন, ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার খসড়া কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত হলে চলমান বিভিন্ন অভিযোগের অবসান ঘটানো সম্ভব হবে। নতুন আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারীদের জন্য আলাদা কর্নার করা হচ্ছে। বিভিন্ন দুর্যোগে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্ধারে ৬০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা কেনা হচ্ছে।

প্রতীকী ছবি
অলংকরণ: শাকিলা খান


আলোচনায় ইউএনএফপিএর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট শামিমা পারভীন ২০১৬ সালে সাইক্লোনের সময় এক কিশোরীর কাছ থেকে শোনা একটি বক্তব্য উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কিশোরীটি জানিয়েছিল, বড় বন্যা হয় কি না, তা নিয়ে সে ভয়ে থাকে। আর একই সঙ্গে ভয় থাকে আশ্রয়কেন্দ্রে রাত কাটানো নিয়ে, যেখানে নারী ও পুরুষ সবাই এক ঘরেই থাকেন।

শামিমা পারভীন বলেন, ‘নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে আমরা যাঁরা কাজ করছি, এই কিশোরীর জায়গায় নিজের কিশোরী মেয়েকে চিন্তা করলে আর পরবর্তী দুর্যোগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম না, তার আগেই আমরা অবকাঠামো পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা করতাম।’

শামিমা পারভীন করোনায় নারী নির্যাতন বাড়লেও নারীদের সেভাবে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, করোনায় সরাসরি সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সব নারীর হাতে মুঠোফোন নেই। একবার কোনোভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব হলেও পরে আর ওই নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না।

আলোচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন, বিভিন্ন দুর্যোগ আঘাত হানবে, তা যেমন সবাই জানে, তেমনি দুর্যোগে নারীর ভোগান্তি বা সমস্যার কথাগুলোও সবার জানা। বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সরকারের আইন, নীতি, কমিটিও আছে। তবে সেগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না, তা নজরদারি বা জবাবদিহির জায়গাটা পাকাপোক্ত নয়। বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে, তবে ফান্ড বন্ধ হয়ে গেলে কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। তা টেকসই হচ্ছে না। সরকারি–বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কমিউনিটি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি।


ওয়েবিনারে সভাপতির বক্তব্যে একশনএইড বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক ফারাহ্‌ কবির বলেন, ১৯৮৮ সালের বন্যার পর গবেষণায় দেখা যায়, টয়লেটের সমস্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে নারীরা সারা দিন পানি খান না বা কম খান। ২০২০ সালের নারীদের অভিজ্ঞতাও একই কথা বলছে। তবে অগ্রগতি যে একেবারে হয়নি, তা বলা যাবে না। এখন আলোচনায় বিভিন্ন দুর্যোগে নারীদের ত্রাণসহায়তায় স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো সামগ্রীর কথা নারীরাই আলোচনায় আনছেন।

ফারাহ্ কবির বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রের অবকাঠামো তৈরি বা নীতি ও আইন করলেই হবে না, তা ব্যবহারে নারীদের মধ্যে আস্থা আনতে হবে। নারীকে প্রশিক্ষিত ও সচেতন করতে হবে।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারীর নেতৃত্বে পরিচালনা করতে হবে। যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতেও নারীর মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। দুর্যোগে নারীর ভোগান্তি কমাতে বাজেট বরাদ্দের পাশাপাশি বাজেট খরচে কোথাও কোনো দুর্নীতি হচ্ছে কি না, তা–ও নজরদারির আওতায় আনতে হবে। আর দুর্যোগ শুরু হলে নয়, দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনার আলোকে আগাম প্রস্তুতি থাকতে হবে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক কামরুন নাহার; সাতক্ষীরা, বরগুনাসহ দুর্যোগপ্রবণ এলাকার ভুক্তভোগী নারী এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় কর্মরত জনপ্রতিনিধি ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা এ ওয়েবিনারে অংশ নেন।