দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা নিয়ে যাচ্ছেতাই

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

মহাজোট সরকারের দায়িত্ব ছাড়ার ঠিক আগে আগে এক দিনে (গত ১৭ নভেম্বর) ৩২ জনকে দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ নিয়মানুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই অনুদানের জন্য কোনো আবেদন করেননি এবং কেউ তাঁদের জন্য সুপারিশও করেননি৷
বরাদ্দের তালিকায় দুজন জেলা প্রশাসক, ১২ জন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সেনাবাহিনীর একজন জিওসি, একটি এনজিও, একটি কলেজসহ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে অনুদান দেখানো হয়৷ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সব টাকা ছাড়ও করেছে৷
তবে এই তািলকা ধরে ২৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো৷ তাতে দেখা গেছে, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মিরসরাই উপজেলা কমান্ডসহ অন্তত পাঁচজন ইউএনও কোনো টাকা পাননি৷ তাঁদের নামে বরাদ্দ দেখানো আছে ৪০ লাখ টাকা৷ একজন ইউএনও এক লাখ টাকা পেয়েছেন, কিন্তু মন্ত্রণালয়ের তালিকায় দেখা যাচ্ছে তাঁর নামে বরাদ্দ করা আছে ১০ লাখ টাকা৷ আরেকজন ইউএনওর নামে বরাদ্দ দেখানো আছে ১০ লাখ, পেয়েছেন তিন লাখ৷ আরেকজন ইউএনওর নামে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ, তিনি পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা৷

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলামের নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৪১ লাখ ৪০ হাজার টাকা৷ এর মধ্যে নগদ চেকে ইউএনওর কাছে পাঠানো হয় ৪০ লাখ টাকা৷ মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকীর বাবার প্রতিষ্ঠিত কলেজের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা৷
কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, ‘দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা নৌকমান্ডারদের তালিকা’ লিখে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা৷ আরও সাতজনের নাম তালিকায় আছে, যাঁদের কোনো পরিচয় লেখা নেই৷ ফলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি৷
বরাদ্দের এ তালিকা অনুমোদন করেছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম ও বর্তমান সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী। মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণের জন্য সরকারি হাটবাজারের ইজারা থেকে প্রাপ্ত টাকার ৪ শতাংশ স্থানীয় সরকার বিভাগ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে দিয়েছে৷ সেই অর্থই এভাবে বরাদ্দ করা হয়েছে৷ নীতিমালা অনুযায়ী, মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা ও সচিব ৩০ হাজার টাকা অনুদান দিতে পারেন৷ কিন্তু তাঁরা অমুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বরাদ্দ দিয়েছেন৷
মূলত দুস্থ মুিক্তযোদ্ধার গৃহ সংস্কার ও মেরামতের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রধানের সুপারিশে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা, মুক্তিযোদ্ধার চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের সুপারিশ নিয়ে সন্তানের বেতনের জন্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আক্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের ত্রাণসামগ্রী কেনার জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার কথা৷ দুস্থ মুক্তিযোদ্ধার কর্মসংস্থানের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ হাজার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কন্যাসন্তানের বিয়ের জন্য ২০ হাজার টাকা অনুদান দেওয়ার নিয়ম আছে৷ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা দেওয়া যেতে পারে৷
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার কাছে অভিযোগ আসছে, সাত মাস হতে চললেও অনেকেই অনুদানের চেক পাননি।কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে সব টাকা ছাড় করা হয়েছে। আবার মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়, এমন প্রতিষ্ঠানকেও নীতিমালা ভঙ্গ করে অনুদান দেওয়া হয়েছে।এ বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা জানতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।’

মন্ত্রী আরও বলেন, ‘চেক না পাওয়ার অর্থ স্পষ্টই বোঝা যায় এই চেকের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিবেদন পেলেই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নীতিমালা ভঙ্গ করে এক টাকাও কাউকে বেশি অনুদান দেওয়া অপরাধ৷ আর যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা বঞ্চিত, সেখানে অন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অনুদান দেওয়া আরও বড় অপরাধ৷’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাবেক প্রতিমন্ত্রীর এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের বেসরকারি সংস্থা স্বদেশ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানটিকেও ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছে। জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আ. হক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ভবিষ্যতে অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করবেন। টাকা ব্যাংকে জমা আছে। দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের এই টাকা আপনি কীভাবে পেলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি রাজনীতি করি, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক৷ এ ছাড়া, মন্ত্রণালয়ের অনেকেই পরিচিত ছিলেন৷’
বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ তখন ইউএনও ছিলেন এ টি এম কাউছার হোসেন৷ তিনি এখন চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলায় কর্মরত। জানতে চাইলে কাউছার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোনো আবেদন করিনি। আবার এ টাকা কোন খাত থেকে এসেছে বা কে দিয়েছে, সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা বা চিঠি ছিল না। এদিকে, সরকারি টাকা “নগদ চেক” হিসেবে এসেছে, যা নিয়ে আমি খুব দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। সন্দেহ হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গেই তা আমি উপজেলার সরকারি হিসাবে (জনতা ব্যাংক বাঞ্ছারামপুর শাখা) জমা দিয়ে দিই।’
এ ছাড়া, বাঞ্ছারামপুরে কবি নজরুল পাঠাগারের সভাপতি সাইদুর রহমানকে ৫০ হাজার, কদমতলী গ্রামের আবদুল খালেককে ২০ হাজার, ফরদাবাদ গ্রামের জোহরা খাতুনকে ২০ হাজার, নেমতাবাদ গ্রামের শাহাজাহান সরকারকে ৩০ হাজার, ছয়ফুল্লাকান্দি গ্রামের ফেরদাউস মিয়াকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে বলে তালিকায় দেখা যায়৷
নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়ায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের বাবার নামে প্রতিষ্ঠিত মওলানা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী কলেজকে ১০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয় । প্রথম আলো এ বিষয়ে খোঁজখবর শুরু করলে গত ২১ মে ওই ১০ লাখ টাকাসহ ২০ লাখ টাকা ফেরত দেয় কলেজ কর্তৃপক্ষ৷ পরে জানা যায়, এই কলেজকে এর আগেও ১০ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। টাকা ফেরতের সঙ্গে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, নারীর ক্ষমতায়ন ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের উদ্বোধনকালে মুক্তিযোদ্ধাদের সমাবেশে অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম।

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসকের নামেও অনুদান দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ বলেন, তাঁরা এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুদান পাননি।
টাঙ্গাইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহজাহান মোমেনকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। কিন্তু ওই নামে সাম্প্রতিক সময়ে েসখানে কোনো ইউএনও ছিলেন না৷ সেখানকার বর্তমান ইউএনও ইসরাত জাহানও বলেন, ‘টাঙ্গাইলে এ নামে কেউ নেই, আমরা কোনো চেকও পাইনি।’
কিশোরগঞ্জ সদরের ইউএনওর নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১০ লাখ টাকা৷ ইউএনও সুব্রত পাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে এখানে আছি, এত বড় অঙ্কের টাকা দেওয়া হলে তো জানতাম। আর আমরা কোনো আবেদনও করিনি।’
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। সে সময় থেকে গত ২৭ মার্চ সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন ইউএনও রেজাউল করিম। তিনি বলেন, ‘আমি থাকা পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অনুদান আসেনি।’
কেন্দুয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল ইসলামকে দেওয়া হয়েছে এক লাখ টাকা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে কেন্দুয়া বিষয়ে বই লেখার জন্য তাঁকে এ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের টাকা বই লেখার জন্য নেওয়া যায় কি না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমার জানার বিষয় নয় তাঁরা কোথা থেকে দিয়েছেন।’
চট্টগ্রামের মিরসরাই মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উপজেলা কমান্ডার কবীর আহম্মেদকে পাঁচ লাখ টাকার অনুদান দেওয়ার কথা তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে উপজেলা কমান্ডার প্রথম আলোকে জানান, তাঁকে এ ধরনের কোনো চেক দেওয়া হয়নি। কিছু জানানোও হয়নি।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও বরাবর বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ২০ লাখ টাকা। ইউএনও মোমিনুর রহমান জানান, তাঁর এ বিষয়ে কিছু জানা নেই।
নেত্রকোনার পূর্বধলার ইউএনও বরাবর ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেখানো হয়েছে। ইউএনও হেলাল উদ্দিন বলেন ‘আমি এক লাখ টাকার একটি চেক পেয়েছি। তবে এ জন্য কোনো আবেদন করিনি।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ইউএনও আশরাফুল ইসলামের নামে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ১০ লাখ টাকা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিন লাখ টাকার চেক পেয়েছেন। তবে কেন, কোন খাত থেকে পাঠানো হয়েছে, তা তিনি জানেন না।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের ইউএনওর নামে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। তালিকায় হাতে লিখে এ নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনও দেবময় দেওয়ান বলেন, ২০ দিন আগে তিনি দেড় লাখ টাকার একটি চেক পেয়েছেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী বলেন, ‘হয়তো মন্ত্রণালয় থেকেই কিছু কর্মচারী চেক বিতরণে অনিয়ম করেছেন৷ তাই অনেকে চেক পাননি। তবে কেন অনেক জেলায় কম টাকা দেওয়া হয়েছে, তা আমরা খতিয়ে দেখব।’
বেসরকারি সংস্থা স্বদেশ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন ও কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান কীভাবে এ খাতের টাকা পেল—জানতে চাইলে সচিব দাবি করেন, ‘মন্ত্রণালয়ে কোনো নিজস্ব লোক নেই, কিছু লোক আসে সংসদ সচিবালয় থেকে, কিছু আসে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে। এ জন্যই এত অনিয়ম হচ্ছে।’
সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগের বিষয়, কাগজপত্র না দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়।’