দূর থেকে রোগী দেখা

ভিডিও কলে রোগী দেখছেন ডা. নাঈমাছবি: খালেদ সরকার
তানজিনা হোসেন

করোনা মহামারি শুরুর পরই বাংলাদেশে টেলিমেডিসিন প্রথমবারের মতো বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ বছরের মার্চে দেশজুড়ে শুরু হয় সাধারণ ছুটি ও লকডাউন। জরুরি স্বাস্থ্যসেবা বাদে অন্যান্য সাধারণ রুটিন সেবা, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বার, ক্লিনিক একে একে বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় মহামারি মোকাবিলার উদ্দেশ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও সাধারণ ও রুটিন সেবা স্থগিত করার পক্ষেই মত দেয়। তখনই সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে টেলিমেডিসিন সেবার প্রচলন শুরু হয়।

সরকার ওয়েবসাইট (স্বাস্থ্য বাতায়ন), হটলাইনের মাধ্যমে টেলিফোন সেবা শুরু করে রোগীদের প্রশ্ন-উত্তর ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য। এ পদ্ধতি আরও বেশি করে প্রচলন করা হয় কোভিড রোগীদের বাড়িতে রেখে সেবা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। করোনা পরীক্ষার সিরিয়াল নেওয়া, করোনা রিপোর্ট খুদে বার্তার মাধ্যমে পাঠানো থেকে শুরু করে টেলিফোনে বাড়িতে চিকিৎসা বাতলে দেওয়া পর্যন্ত প্রতিটি পদেই টেলিমেডিসিনের সাহায্য নেওয়া হয়। বিপুলসংখ্যক করোনা রোগী এ পদ্ধতিতে বাড়িতে থেকে চিকিৎসাসেবা নিয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে। ক্রমে চিকিৎসকেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং চিকিৎসকদের বিভিন্ন সোসাইটি বিভিন্ন মাধ্যমে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে পরামর্শ দিতে শুরু করে।

মার্চে চালু হওয়ার পর থেকে অক্টোবরের শেষ পর্যন্ত সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়ন, ৩৩৩ নম্বর এবং আইইডিসিআরের হটলাইনগুলোতে করোনাসংক্রান্ত মোট ফোনকলের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ২৩ লাখ ২৪ হাজার ৪৫০। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর টেলিমেডিসিন সেবা দিয়েছে ৫ লাখ ১৬ হাজার ২৮৪ জনকে। (সূত্র: এমআইএস/আইইডিসিআর/স্বাস্থ্য অধিদপ্তর)।

রোগী দূরবর্তী কোনো স্থান, এমনকি অজপাড়াগাঁ থেকেও উন্নত সেবা নিতে পারেন। এ জন্য তাঁকে সময় ও অর্থ ব্যয় করে নির্ধারিত দূরবর্তী স্থানে যেতে হয় না।

পাশাপাশি চিকিৎসকদের বিভিন্ন সোসাইটি ও গ্রুপ শুরু থেকেই মোবাইল ফোন, ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে বিনা মূল্যে টেলিমেডিসিন সেবা শুরু করে। অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি (ওজিএসবি) সংকটের সময় সারা দেশে সাড়ে ৩ লাখ নারীকে স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিসেবা দিয়েছে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে, বিনা মূল্যে। চিকিৎসকেরা ব্যক্তিগত বা দলীয় উদ্যোগেও কিছু টেলিমেডিসিন সেবা চালু করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, চাইল্ড করোনা অ্যাওয়ারনেস নামে একটি ফেসবুক গ্রুপে এ পর্যন্ত ১২০ জন চিকিৎসক আর ১৯ হাজার ৪০০ জন অভিভাবক যুক্ত হয়েছেন। গত ৫ এপ্রিল গ্রুপটি খোলা হয়। এ পর্যন্ত ১৩ হাজার অভিভাবককে প্রায় ২৯ হাজারবার বিনা মূল্যে টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়া হয়েছে এই গ্রুপ থেকে। ক্রমে ব্যক্তিগত ও বেসরকারি পর্যায়ে অর্থের বিনিময়ে টেলিমেডিসিন সেবাও চালু হয়েছে ব্যাপকভাবে। যেসব জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক কোভিডের কারণে সরাসরি রোগী দেখা বন্ধ রেখেছিলেন, তাঁরাও ক্রমান্বয়ে এ পদ্ধতিতে যুক্ত হয়েছেন।

বর্তমানে স্বাভাবিক রুটিন স্বাস্থ্যসেবা আবার চালু হলেও টেলিমেডিসিন সেবা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি; বরং এ সময়ে এটি একটি অভূতপূর্ব বিষয় হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। করোনা মহামারি কেটে যাওয়ার পরও আমাদের মতো দেশে, যেখানে প্রত্যন্ত এলাকায় সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা নেই, টেলিমেডিসিন হয়ে উঠতে পারে একটি কার্যকর ব্যবস্থা।

টেলিমেডিসিনের সুবিধা–অসুবিধাগুলো এবার আলাপ করা যাক। সুবিধা হচ্ছে এতে রোগী দূরবর্তী কোনো স্থান, এমনকি অজপাড়াগাঁ থেকেও উন্নত সেবা নিতে পারেন। এ জন্য তাঁকে সময় ও অর্থ ব্যয় করে নির্ধারিত দূরবর্তী স্থানে যেতে হয় না। শিশু, অন্তঃসত্ত্বা, বয়োজ্যেষ্ঠ, পঙ্গু ব্যক্তি বা যাঁরা একা থাকেন, তাঁরা বাড়িতে বসেই স্বচ্ছন্দে অন্য কারও সাহায্য ছাড়াই সেবা পেতে পারেন। অসুবিধা হলো, সরাসরি রোগীর গায়ে হাত দিয়ে পরীক্ষা করার সুযোগ নেই। ফলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যায়। সব বিষয়ে টেলিমেডিসিন প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তিগত সুবিধা, থ্রি–জি বা ফোর–জি নেটওয়ার্ক না–ও থাকতে পারে। এটি ব্যবহার করার জন্য যথেষ্ট প্রযুক্তিজ্ঞান দরকার বলে অনেকেই এ পদ্ধতিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না–ও করতে পারেন। গোপনীয়তা কীভাবে রক্ষা হবে, সেটাও বিষয়। তা ছাড়া আইনি দিক বা নীতিমালা এখনো স্পষ্ট নয়।

তবে কোভিড মহামারি শিক্ষা, ব্যবসা–বাণিজ্যসহ স্বাস্থ্য খাতেও যে প্রভূত পরিবর্তন এনেছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে টেলিমেডিসিন বা ভার্চ্যুয়াল স্বাস্থ্যসেবা চিকিৎসা খাতে একটি বিশেষ স্থান দখল করতে যাচ্ছে।

ডা. তানজিনা হোসেন ঢাকার গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক