দূর পাহাড়ের ওপারে ইয়ামথাংয়ে

নেপাল, ভুটান ও চীনের সীমান্তঘেঁষা সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক থেকে ১৪৮ কিলোমিটার পাহাড়ি বন্ধুর পথ বেয়ে লাচুং হয়ে পৌঁছাতে হয় ইয়ামথাংয়ে। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু
নেপাল, ভুটান ও চীনের সীমান্তঘেঁষা সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক থেকে ১৪৮ কিলোমিটার পাহাড়ি বন্ধুর পথ বেয়ে লাচুং হয়ে পৌঁছাতে হয় ইয়ামথাংয়ে। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু

ইয়ামথাং মূলত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১ হাজার ৮০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সাদা বরফে আচ্ছাদিত সিকিমের এক অপরূপ উপত্যকা। বসন্তে নানা রং ও বর্ণে রঙিন হয়ে ওঠে বলে স্থানীয় মানুষের কাছে ইয়ামথাং পরিচিত ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস বা ফুলের উপত্যকা হিসেবে। নেপাল, ভুটান ও চীনের সীমান্তঘেঁষা সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক থেকে ১৪৮ কিলোমিটার পাহাড়ি বন্ধুর পথ বেয়ে লাচুং হয়ে পৌঁছাতে হয় এই ইয়ামথাংয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি, আমরা দুজন (পড়ুন আমরা কজন) চলতি হাওয়ার পন্থী। কোনো চলতি হাওয়ায় গা ভাসানো নয়। দীর্ঘ এক বছর ধরে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার অংশ এই সার্ক শিক্ষাসফর ২০২০। আয়োজন করেছে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব সারথি।

সারথির সদস্যরা খেটেখুটে ঢাকা-শিলিগুড়ি টিকিট থেকে শুরু করে সিকিমে থাকা–খাওয়ার হোটেল, জিপসহ সবকিছু জোগাড় করলেও আমাকে সারথির সঙ্গী হতে হয়েছে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দিনব্যাপী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানের দৌড়ঝাঁপ শেষ করেই এভাবে বহুদূর পথ পাড়ি দিতে হবে কে জানত! সারথির সদস্যদের বহনকারী বাস ঢাকার কল্যাণপুর থেকে ছেড়ে সাভার অতিক্রম করবে রাত ১১টা নাগাদ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রান্তিক গেটে হাজির হলে ওরা আমায় তুলে নিল, যেন ‘তুলে নিল দ্রুত রথে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে’। পরিচিত লোকালয় হতে বহুদূরে, দেশ হতে দেশান্তরে।

লাল-সাদা পতাকায় মোড়ানো গিরিপথ
বন্ধুর ও বহুদূর পথ, গ্যাংটক থেকে লাচুং হয়ে ইয়ামথাং। সকাল সকাল গ্যাংটক থেকে যাত্রা করে আমাদের ১০ জনের দলকে নিয়ে গাড়ি চলছে উঁচু-নিচু পথে। ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার গাড়ির গড় গতি। এর চেয়ে গতি বাড়ানোর গতি নেই। গতি বাড়ালে ঝুঁকি আছে, জানালেন জিপের চালক। যেতে যেতে জানালার কাচ ভেদ করে চোখ আটকায় পাহাড়ি নদীর নীল-সবুজ জল, পাহাড়ি ঘেরাটোপ আর পাহাড়ের ঘন অরণ্যে। মন চায় আরণ্যক হই। পথে পথে কখনো গাড়ির পথ আটকাল প্রজাপতি ঝরনা, কখনো ঝুপড়ি চায়ের দোকান, কখনো মস্ত পাহাড়, ব্রিজ ও বাঁধ। পাহাড়ি পথের দুই ধারে লাঠি ও দড়িতে বাঁধা লাল, সাদা, নীল ও হলুদ রঙের পতাকায় লেখা কতশত শব্দ, আপ্তবাক্য। মূলত মৃত মানুষের জন্য স্বর্গ প্রার্থনা করে, প্রিয়জনের আত্মার শান্তির জন্য লেখা হয় বহু বর্ণিল এই পতাকায়। প্রাচীন সময় থেকে সিকিমের মানুষের মধ্যে এই বিশ্বাস প্রোথিত যে, পথের ধারে স্বর্গ কামনা করে নিশান ওড়ালে প্রিয় মানুষটি হয়তো স্বর্গবাসে যাবে। পথের দুই ধারে পতাকা সাঁটানোর এই রীতি ধর্মবিশ্বাসবিধৌত হলেও এই পতাকা যে পাহাড়ি পথের শোভা বাড়িয়েছে, এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

তলানিতে তাপমাত্রা

রঙের অপূর্ব খেলায় উজ্জ্বল পাহাড়ি উপত্যকা। সাদা বরফে কাঁচা সোনা রং। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু
রঙের অপূর্ব খেলায় উজ্জ্বল পাহাড়ি উপত্যকা। সাদা বরফে কাঁচা সোনা রং। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু

জানুয়ারির শেষাশেষিতে গ্যাংটকে পৌঁছে আন্দাজ পেলাম কী ঠান্ডা নেমেছে! চকচকে পথঘাট, ধুলাবালু নেই, প্লাস্টিকের ছড়াছড়ি নেই, গাড়ির হর্ন নেই আর নেই অযথা বিলবোর্ডের বাহুল্য। তবে ঠান্ডা সীমাহীন। জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে রাতের গ্যাংটকে গড় তাপমাত্রা ১০–এর নিচে। এভাবে আপনি সিকিমের যত উত্তরে পৌঁছাবেন, তাপমাত্রা তত তলানিতে নামবে।

গ্যাংটকে এক রাত থেকে পরদিন সকালে রওনা হয়ে সন্ধ্যার খানিক পরে পৌঁছালাম লাচুং। ততক্ষণে পাহাড়ি সড়কের দুই ধার বরফে সাদা হয়ে উঠেছে। রিসোর্টের নাম সানফ্লাওয়ার, বাঙালি আয়োজন, খাবারদাবার থেকে আচার-ব্যবহার। লাচুংয়ে রাতের তাপমাত্রা তখন মাইনাসে গড়াগড়ি খাচ্ছে, আমাদের কারও কক্ষে তাপানুকূল কোনো ব্যবস্থা—এসি/রুমহিটার নেই।

পানের উপযোগী পানীয় জল নেই, যা আছে বরফ গোছের কিছু একটা হবে। সবার ওয়াশরুম ব্যবহার, ব্রাশ, হাত-মুখ প্রক্ষালন আটকে গেল হিমশীতল জলে। তবু কোনোমতে বের হলাম, কাটাও ও ইয়ামথাংয়ের পথে।

গয়ালের উপত্যকা
বেলা বাড়তে থাকলে সূর্যও তার রং ও উত্তাপ ছড়িয়ে দিল। রঙের অপূর্ব খেলায় উজ্জ্বল হলো পাহাড়ি উপত্যকা। সাদা বরফে কাঁচা সোনা রং। গিরিপথে মুহূর্তেই ছড়িয়ে গেল স্বর্গীয় আভা। এই দৃশ্য দেখে বর্ণনাহীন উত্তেজনায় রঙিন হলো মন।

পাহাড়ি পথ, একই স্থানে বারবার ঘুরপাক খায়, দস্যি মেয়ের এলোমেলো সিঁথির মতো রেখা ধরেই ইয়ামথাংয়ের পথে ধীরে ধীরে এগোতে থাকল আমাদের গাড়ি; মন জানতে চাইল, গাড়ি, তোমার কোনো বাড়ি আছে? পথের ওপরেই বারবার পথ আটকাল গয়াল। শরীরে ঘন কালো লম্বা কেশ, মাথায় মহিষের মতো শিং ও নম্র স্বভাবের এই গয়াল পাহাড়ি পথের ধারে সৃষ্টি করে মিষ্টি উত্তেজনা।

মেঘ-পাহাড়-বরফের মিতালির ছবি মনে মনে এঁকে তুলে নিলাম ক্যামেরায়। বহুকাল অক্ষয় থাকুক এই ছবি, মনের অন্দরে, অলিন্দে। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু
মেঘ-পাহাড়-বরফের মিতালির ছবি মনে মনে এঁকে তুলে নিলাম ক্যামেরায়। বহুকাল অক্ষয় থাকুক এই ছবি, মনের অন্দরে, অলিন্দে। ছবি: কাওসার আবেদিন সেতু

ইয়ামথাংয়ে পৌঁছে দেখি মানুষের ঢল, তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাঙালি, কেউ কেউ বাংলাদেশি। মেঘ-পাহাড়-বরফের মিতালির ছবি মনে মনে এঁকে নিলাম সবাই, তুলে নিলাম ক্যামেরায়। বহুকাল অক্ষয় থাকুক এই ছবি, মনের অন্দরে, অলিন্দে।