দূরত্ব যতই হোক, প্রাণের মেলায় ছুটে আসতেন তাঁরা

বাংলা একাডেমি
ছবি: সংগৃহীত

মাসব্যাপী আয়োজিত অমর একুশে বইমেলায় দূরদূরান্ত থেকে আসা এখনকার মতো সহজ ছিল না সব সময়। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল কঠিন। সত্তরের শেষ আর আশির দশকের শুরুতে দূরের জেলা রাজধানীতে আসতে কখনো কখনো বাস বা ট্রেনেই বসে থাকতে হতো গোটা একটা দিন। সেই সময় বইমেলায় আসা মানুষদের এখন বয়স হয়েছে অনেক। এ প্রজন্মের বইপ্রেমীদের জন্য তাঁরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন ময়মনসিংহ, সিলেট ও রাজশাহী থেকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে বইমেলায় আসার গল্প। তাঁরা বলেছেন, কষ্ট হলেও প্রাণের টানে অতিক্রম করতেন দীর্ঘ এই পথ।

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে তখন বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। সন্ধ্যা হলেই ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যায়। দু-একটা পাঠাগার ছাড়া বই কিনতে হলে যাও ময়মনসিংহ সদরে। ঢাকা-ময়মনসিংহ লোকাল ট্রেনটি তখন গফরগাঁও স্টেশনকে একেবারেই পাত্তা দেয় না। থামে মাত্র পাঁচ থেকে সাত মিনিটের জন্য। ১৯৭৭ সালের দিকের কথা। তখনো সরকারি হয়নি গফরগাঁও কলেজ। সে কলেজে সমাজকর্ম বিভাগের তরুণ শিক্ষক ছিলেন আলতাফ হোসেন।

আমাদের সময়ে দেখা বইমেলা থেকে একটি ব্যাপার শিখেছি, কবি-সাহিত্যিকদের ভালোবাসা যায়।
আলতাফ হোসেন

ছয় ফুটের বেশি উচ্চতার মানুষটির কাঁধে তখন থেকেই থাকে একটা ঝোলা ব্যাগ। সে ব্যাগ আসলে এক বিস্ময়কর জাদুর থলে। ওর মধ্যে বাঁশি, বিচিত্র বইপত্র আর আঁকাজোকার কাগজ-কলম থাকে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে প্রায়ই দেখা যায়, দীর্ঘদেহী এক তরুণ হন্তদন্ত হয়ে ছুটছেন রেলস্টেশনের দিকে। টুক করে উঠে পড়তেন লোকাল ট্রেনের কামরায়। উদ্দেশ্য একটাই—বইমেলায় যাওয়া। তখনকার কলেজশিক্ষকদের ইচ্ছা হলেই বই কেনার সামর্থ্য ছিল না। তাই বলে বই ভালোবাসতে তো আর আপত্তি নেই।

আলতাফ হোসেন সকালে রওনা হয়ে গফরগাঁও থেকে আসতেন ঢাকায়। কোনো এক হোটেলে ঢুকে কিছু একটা খেয়েই যেতেন বাংলা একাডেমি চত্বরে। সে সময়ের বইমেলার স্মৃতি জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তখনো অমর একুশে বইমেলার এই রূপ হয়নি। যত দূর মনে পড়ে, বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে চিত্তরঞ্জন সাহার সঙ্গে দু-একজন করে প্রকাশক যোগ দিচ্ছেন। একটু একটু করে প্রতিবছর বড় হচ্ছে মেলার আয়তন। মানুষ পরিবার নিয়ে আসত, আমোদে হাসত। পাগল লেখকেরা নিজের বই হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন, যদি কেউ কেনে একটা।’

এমনও হয়েছে, মেলায় আসতে ছুটি লাগবে, তাই অসুস্থ শরীরেও কাজ করেছি।
রায়হান ই জান্নাত

গত শতকের সত্তরের দশকের শেষ সময়ের মেলার সঙ্গে বর্তমান আয়োজনের বড় পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয় ৮০ বছর স্পর্শ করতে যাওয়া অধ্যাপক আলতাফ হোসেনকে। তিনি বলেন, ‘এখন মফস্বল থেকেও খুব সহজেই মেলায় আসা যায়। অত ভোগান্তি নেই। তখন বাংলা একাডেমির মাঠে অল্প কয়েকটি দোকান ছিল। পুকুরের ওই পাশ অন্ধকার থাকত। তবু পুরোটা যে কতবার চক্কর দিতাম! এখন মেলায় আসার আগ্রহ পরাজিত হচ্ছে বয়সজনিত জরাব্যাধির কাছে। আমাদের সময়ে দেখা বইমেলা থেকে একটি ব্যাপার শিখেছি, কবি-সাহিত্যিকদের ভালোবাসা যায়। একটু একটু করে সেটা শিখিয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। কয়েকবার তিনি আমার বাড়ির অতিথি হয়েছেন। দেখেছি, লেখকদের মগ্নতা জানতে হয়। বইমেলার পরিধি, বইয়ের বাড়তি সংখ্যা—এসব তো স্বাভাবিক ধারা। এমনই হওয়ার কথা। মেলার মাঠের মাঝখানে রাজার পোশাক গায়ে বাঁশি বাজান একজন মানুষ। দেখেছেন? মানুষটিকে আমার খুব ভালো লাগে। বিনিময় ছাড়াই মানুষকে আনন্দ দিচ্ছেন তিনি। এ-ও তো মেলা বলেই পাওয়া!’

আলতাফ হোসেনের বয়স কয় দিন পরই ৮০ হবে
ছবি: সংগৃহীত

আলতাফ হোসেন ফরিদপুর ইয়াসিন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০০৬ সালে। বাড়িতে এখন তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। কুটির শিল্প নিয়ে কাজ তাঁর শখ। কাগজ কেটে কেটে বানান একুশের সংকলন। ৪৫ বছর আগে ঢাকা থেকে ফেরার সময় আলতাফ হোসেনের দুহাত ভর্তি থাকত নতুন-পুরোনো বইয়ে। ঢাকা-ময়মনসিংহ লোকাল ট্রেনে উঠে গফরগাঁও স্টেশনে পৌঁছাতেন রাত প্রায় ১২টার দিকে। পাড়াগাঁয়ে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু-একটা ভ্যান হয়তো তখন যাই–যাচ্ছি করেও আছে স্টেশনের কাছে। ভ্যানচালকদের কাউকে অনুরোধ করে তুলে দিতেন বইয়ের বোঝা। সারা দিন পর প্রথম টের পেতেন ব্যথায় টনটন করছে দুহাত। তবে সে ব্যথা বড় আনন্দের ছিল।

নিজের হাতে বানানো একুশের সংকলন। বইয়ের রাজ্য তাঁর আনন্দের জায়গা
ছবি: সংগৃহীত
বই ভালোবেসে ঝুঁকি নিয়ে বহুদূরের পথ অতিক্রমের গল্প নারীদেরও কম নেই। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে বাসে ঢাকায় আসতে অন্তত ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। ট্রেনে এলে কম করে হলেও ১৪ ঘণ্টা। তখন সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলেন রায়হান ই জান্নাত। বইমেলা উপলক্ষে হোস্টেল থেকে আসতেন ঢাকায়।

বই ভালোবেসে ঝুঁকি নিয়ে বহুদূরের পথ অতিক্রমের গল্প নারীদেরও কম নেই। গত শতকের আশির দশকের শুরুতে সিলেটের গোয়াইনঘাট থেকে বাসে ঢাকায় আসতে অন্তত ১০ ঘণ্টা সময় লাগত। ট্রেনে এলে কম করে হলেও ১৪ ঘণ্টা। তখন সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্রী ছিলেন রায়হান ই জান্নাত। বইমেলা উপলক্ষে হোস্টেল থেকে আসতেন ঢাকায়।

রায়হান ই জান্নাত অবসরে গেছেন গত বছর।
ছবি: সংগৃহীত

চাকরির শুরুতে পোস্টিং হলো সিলেটের গোয়াইনঘাটে। ১৯৮৪ সালের দিকের কথা। সংসার হয়েছে, সন্তান এসেছে, তবু তাঁকে প্রতিবার মেলায় আসতেই হবে। ব্যাগ গুছিয়ে যাত্রা করতেন জান্নাত। তবে আর সবকিছু গোছানো গেলেও কঠিন হতো ছুটি পাওয়া।
প্রথম আলোকে জান্নাত বলছিলেন, ‘এমনও হয়েছে, মেলায় আসতে ছুটি লাগবে, তাই অসুস্থ শরীরেও কাজ করেছি। এম আর আখতার মুকুলের বই খুঁজেছি, মহাদেব সাহার কবিতার বইয়ের জন্য অপেক্ষা করতাম আমরা। তখনকার লেখকদের মধ্যে কেউই প্রায় ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলেন না। তবু তাঁদের খুব আপন মনে হতো। একবার আমার হাতে হুমায়ূন আহমেদের অনেকগুলো বই ছিল। তিনি তখনো অত বিখ্যাত হননি। জানতে চাইলেন, আমার তো আরও একটা বই আছে, সেটা নেবেন না? বললাম, আগেই পড়েছি। অথচ এখন দেখুন, ঘটছে উল্টো। ২০১৮ সালে মেলায় প্রবেশের সময় একটা খারাপ লাগার স্মৃতি আছে আমার। মেলায় ঢুকছি। হঠাৎ শুরু হলো পুলিশের তৎপরতা। সবাইকে একপাশে দাঁড় করাল। কোনো একজন বড় লেখক প্রবেশ করবেন মেলায়। কষ্ট পেয়েছি, অবাকও হয়েছি এ ঘটনায়। এখন মেলায় যে অনেক বই আসে, এটা ভালোই লাগে। এর মধ্যে যা কালোত্তীর্ণ হওয়ার মতো তা হবে। আর যা মানোত্তীর্ণ না, তা আপন নিয়মেই হারিয়ে যাবে।’

পরিবারের সবাইকে নিয়ে জান্নাত এখনো নিয়মিত বইমেলায় যান
ছবি: সংগৃহীত

চিকিৎসক জান্নাত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক হিসেবে অবসর নিয়েছেন ২০২১ সালে। পরিবার আর আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে এখনো প্রতিবছর বইমেলায় ঠিকই হাজির হন তিনি। তাঁর পরিবারের কয়েকজন লেখক। তাঁদের বই প্রকাশ হয় বলে এখনকার মেলার আনন্দ জান্নাতের কাছে আরেক রকম। তবে সেই তরুণ বয়সে গোয়াইনঘাট থেকে ঢাকায় বইমেলায় আসার স্মৃতি তাঁর কাছে বিশেষ হয়ে আছে। তিনি জানান, তাঁর ঘরভর্তি আছে নানা রকম পুরোনো বই।

এমন ঘরভর্তি বই নিয়ে এখন মফস্বলে একা জীবন যাপন করছেন হোসনে আরা মঞ্জু। সম্প্রতি তিনি নতুন বইয়ের জন্য জায়গা করতে বাড়ি থেকে সরিয়েছেন কিছু পুরোনো বইপত্র। এই পুরোনো বইয়ের ওজন ২১৮ কেজি।

হোসনে আরা মঞ্জুর কাছে বইমেলা সব সময়ই সুন্দর
ছবি: সংগৃহীত

গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝিতে মঞ্জু ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘তখন ঢাকায় আসতে যেমন ছিল যাত্রাপথের কষ্ট, আবার বই কিনে বয়ে নিয়ে যাওয়ারও ছিল হ্যাপা। তবু মেলায় না এলে মনে হতো, সে বছরের সবচেয়ে বড় আয়োজনেই অনুপস্থিত রয়ে গেলাম। মেলার জন্য নতুন শাড়ি কিনতাম। তখনকার মেলায় মানুষের ভিড় কম হতো। এখন যাঁরা মেলায় আসেন, তাঁদের সবার উদ্দেশ্য বই কেনা নয়। তবে এখনো অনেক বইপ্রেমী মেলায় আসেন। কয়েক বছর আগের এক মেলায় বইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চার যুবক এগিয়ে এলেন। প্রথমে একটু চমকে গিয়েছিলাম। তাঁরা সরাসরি আমাকে বললেন, তাঁদের জন্য বই পছন্দ করে দিতে। ঘটনাটি খুব ভালো লেগেছে।’

নতুন বইয়ের জন্য সরাতে হয়েছে ২১৮ কেজি পুরোনো বই
ছবি: সংগৃহীত

মঞ্জু সমাজবিজ্ঞান পড়াতেন। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ ও সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। পরে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমিতে (নায়েম) কাজ করেছেন। পুরোপুরি অবসর নিয়েছেন ২০০৭ সালে। অবসরজীবনে তাঁর বন্ধু বই। তিনি বলেন, ‘বয়স হলে শরীরে ব্যাধি বাসা নেবে স্বাভাবিক; কিন্তু বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে মনের অসুখ হবে না।’