দূষণরোধে ইটভাটা আইনের সংশোধন দরকার

‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ নিয়ে গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল। পাশে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান l ছবি: প্রথম আলো
‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ নিয়ে গতকাল প্রথম আলো কার্যালয়ে গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল। পাশে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান l ছবি: প্রথম আলো

কৃষিজমি নষ্ট ও পরিবেশের ক্ষতি করে ইট তৈরি বন্ধ করতে হবে। মাটি (টপ সয়েল) দিয়ে ইট বানানো চলবে না। মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যেসব নতুন উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে হবে। সরকারের যেসব বিভাগ অবকাঠামো নির্মাণ ও তা তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়গুলোতে অগ্রাধিকার দিয়ে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩-এর সংশোধন করতে হবে।
গতকাল শনিবার প্রথম আলো ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আয়োজিত ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সহযোগিতা দেয় বিশ্ব পরিবেশ তহবিল (জিইএফ) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
গোলটেবিলের শুরুতেই ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, সরকারিভাবে দেশে বর্তমানে ইটভাটার সংখ্যা ৬ হাজার ৯৩০টি আর বছরে দেশে ইটের চাহিদা দেড় হাজার কোটি। এই ইট প্রস্তুত করতে ১২৭ কোটি সিএফটি মাটির দরকার হয়। যার বেশির ভাগই কৃষিজমির উপরিভাগ (টপ সয়েল) থেকে সংগ্রহ করা হয়।
রিজওয়ানা হাসান বলেন, ইট প্রস্তুত খাত দেশের গ্রিন হাউস গ্যাসের সবচেয়ে বড় উৎস। এ খাতে বছরে ২২ লাখ টন কয়লা ও ১৯ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়, যা বছরে ৮৭ লাখ ৫০ হাজার টন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে। তিনি বলেন, ভারতে ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করতে হয়। বাংলাদেশে তা করতে হয় না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রইছউল আলম মণ্ডল বলেন, ‘কৃষিজমি থেকে মাটি নিয়ে, পরিবেশ ধ্বংস করে ও স্বাস্থ্য খাতের ক্ষতি করে যেভাবে ইটভাটাগুলো চলছে, তা চলতে পারে কি না, আমাদের ভাবতে হবে।’ সরকারি বিভিন্ন কাজে ইটের বিকল্প হিসেবে প্রস্তুত হওয়া উপকরণ ব্যবহারের ব্যাপারে জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সাদেক তাঁর উপস্থাপনায় ইটের বিকল্প হিসেবে বেশ কিছু নির্মাণ উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি তুলে ধরেন। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার ২০২০-এর মধ্যে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে। নদী খনন থেকে উঠে আসা বালু দিয়ে ইটের বিকল্প উপকরণ প্রস্তুত করার তথ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব উপকরণ দিয়ে অনেক উঁচু ভবনও নির্মাণ করা যাবে।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব অমিত কুমার বাউল বলেন, সরকার নিজস্ব প্রকল্পে ইটের বিকল্প উপাদান দিয়ে নির্মাণ শুরু করলে অন্যরা উৎসাহিত হবে। যারা ইটের বিকল্প উপাদান প্রস্তুত করছে, তাদের পণ্য বিক্রি বাড়বে।
বাংলাদেশ অটো ব্রিকস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি নওশেরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরা লাল ইটের বিকল্প হিসেবে বালু দিয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনে ইট প্রস্তুত করেছি। ওই কারখানা স্থাপনে ৮০ কোটি টাকা ব্যয় করেছি। কিন্তু ওই পরিবেশবান্ধব সাদা ইট কেউ কিনছে না। সরকারের কথা মানতে গিয়ে আমি যেন অপরাধী হয়ে গেলাম।’
বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বাবুল বলেন, ‘আমরা সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আধুনিক পদ্ধতিতে ইট তৈরিতে প্রস্তুত। কিন্তু সরকারকে আগে নিশ্চয়তা দিতে হবে যে পরে এসে তারা আবার যাতে না বলে এই পদ্ধতি বাতিল। ভবিষ্যতে মাটি দিয়ে আমরা ইট বানাতে পারব কি পারব না, আইনে দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।’
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও নির্মল বায়ু প্রকল্পের পরিচালক এস এম মঞ্জুরুল হান্নান খান ইটভাটার কারণে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত নানা ক্ষতির বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ঢাকা শহরে প্রতিবছর সাড়ে তিন হাজার মানুষ বায়ুদূষণজনিত অসুখে মারা যায়। এই বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ ইটভাটা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ শীর্ষক গোলটেবিল অনুষ্ঠানে আলোচকেরা l প্রথম আলো
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩’ শীর্ষক গোলটেবিল অনুষ্ঠানে আলোচকেরা l প্রথম আলো

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সোলায়মান হায়দার বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে ইটভাটা-সংক্রান্ত অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে হবে।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সোহেল আহমেদ বলেন, ইটভাটা আইনে বলা হয়েছে, এ-সংক্রান্ত অভিযোগ পরিবেশ আদালতে মীমাংসা হবে। কিন্তু শুধু চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পরিবেশ আদালত এবং ঢাকায় আপিল আদালত আছে। ফলে আইনে সব জেলায় পরিবশে আদালত স্থাপনের বিষয়টিকে যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ইটভাটায় কর্মরত শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়টি আইনে যুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ইটভাটাগুলোর শ্রমিকদের অবস্থা নিয়মিত তদারক করা উচিত।
ইউএনডিপির কর্মসূচি এনালিস্ট আলমগীর হোসেন বলেন, বাংলাদেশের ইটভাটা আইন দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হলেও তা বাস্তবায়নযোগ্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইটের বিকল্প তৈরির জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে একত্রে কাজ করার সুপারিশ করেন তিনি।
পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাছুমুর রহমান বলেন, ইটভাটা পরিদর্শন করতে গিয়ে অনেক সময় ইটের ঢিল খেতে হয়েছে। ফলে আইন এমনভাবে করতে হবে, যাতে তা প্রয়োগের সুযোগ ও জনবলকাঠামো থাকে।
ইটভাটা এলাকার ভুক্তভোগী চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিবাসী আলতাফ হোসেন বলেন, ইটভাটার কারণে তাঁদের এলাকায় রোগবালাই বেড়ে গেছে। আমের ওজন ও স্বাদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আবদুল কাইয়ুম সঞ্চালনার সময় বলেন, ‘আমাদের সামনে তিনটি চ্যালেঞ্জ: প্রথমত, ইটভাটায় বায়ুদূষণমুক্ত ইট তৈরির প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা; দ্বিতীয়ত, মাটির ইটের পরিবর্তে বিকল্প ইট তৈরি; তৃতীয়ত, এসব প্রযুক্তির ব্যবহার গুণ, মান ও দাম—সব দিক থেকে যে ভালো, তা ব্যাপক প্রচার করা দরকার।
বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন ইউএনডিপির গ্রিন ব্রিক প্রকল্পের ব্যবস্থাপক আমান উল্লাহ বিন মাহমুদ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এনার্জি স্টাডিজের অধ্যাপক জিয়াউর রহমান খান, বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির মহাসচিব আবু বকর।