দেশে ই-সিগারেটের নিয়ন্ত্রণ জরুরি

যুক্তরাষ্ট্রে চালানো এক জরিপের তথ্য উঠে এসেছে সিগারেট ধূমপানের চেয়ে ই-সিগারেট বেশি ঝুঁকিপূর্ণ
এএফপির ফাইল ছবি

ইলেকট্রনিক সিগারেট বা ই-সিগারেট থেকে নির্গত সাদা ধোঁয়া দৃশ্যত নিরীহ প্রকৃতির এবং এর মিষ্টি সুবাস প্রচলিত সিগারেটের দুর্গন্ধ থেকে উত্তম। এই তুলনামূলক ধারণারই প্রচার করে থাকেন দেশে ই-সিগারেট আমদানিকারক ও বিক্রেতারা। তাঁদের মতে, ই-সিগারেট প্রচলিত সিগারেটের তুলনায় বেশি নিরাপদ।

ই-সিগারেট নিয়ন্ত্রণে দেশে যখন কোনো ব্যবস্থাই নেই, তখন চটকদার প্রচারে ই–সিগারেটের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে তরুণসমাজ, এমনটাই আশঙ্কা করছে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রকাশিত ‘ইলেকট্রনিক সিগারেটস (ভেপিং) প্রেফারেন্সেস অ্যামাং ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ৩১ দশমিক ২৭ শতাংশ ই-সিগারেট সেবনে বা ভেপিংয়ে অভ্যস্ত অথবা জীবনে একবার হলেও ই-সিগারেট পান করেছেন।

দেশের সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অন্তত ৪০৮ জন শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণাটি করা হয়েছিল। দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারীদের ৬০ শতাংশ ই-সিগারেট সেবনের লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আর ৩৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ বলছেন, ই-সিগারেট তাঁদের তামাকে আসক্ত করে ফেলেছে।

ই-সিগারেট তামাক-নির্ভরতা কমানোতে কার্যকর কি না, এমন একটি বিতর্ক বিশ্বব্যাপী চলছে। আর এ বিতর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যখন ই-সিগারেট বিপণনকারীরা পণ্যটিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।

যদিও গবেষণাটি ই-সিগারেটের স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে করা হয়নি, এটির ভূমিকায় একটি কথা লেখা আছে, ‘সন্দেহাতীতভাবে এটা একটা ভয়ংকর বার্তা যে ই-সিগারেট দেশের তরুণ প্রজন্মকে প্রভাবিত করা শুরু করেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈব রসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক দলের সদস্য ইসমাইল হোসেন জানিয়েছেন, রাসায়নিক পদার্থে যেকোনো ধরনের আসক্তিই স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ই-সিগারেট তামাক-নির্ভরতা কমানোতে কার্যকর কি না, এমন একটি বিতর্ক বিশ্বব্যাপী চলছে। আর এ বিতর্কে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয় যখন ই-সিগারেট বিপণনকারীরা পণ্যটিকে সুস্বাস্থ্যের অধিকার হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন।

বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন জামান ২০১২ সালে প্রথম এ দেশে ই-সিগারেট আমদানি করেছিলেন। তাঁর ধারণা, ই-সিগারেট বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পাবলিক হেলথ, ইংল্যান্ড প্রকাশিত এক তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলছেন, ‘ভেপিং প্রচলিত সিগারেট সেবনের তুলনায় ৯৫ ভাগ নিরাপদ। প্রচলিত সিগারেট থেকে মুক্তি পেতে এটি খুবই কার্যকরী পন্থা।’

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘৯৫ ভাগ নিরাপদ’ তত্ত্বটি এসেছিল ২০১৪ সালে প্রকাশিত ডেভিড নাটের এক প্রতিবেদন থেকে। ডেভিড নাট যুক্তরাজ্যের ঔষধ প্রশাসনের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন। ‘এমডিএমএ এবং এলএসডি নামক ভয়ংকর নেশাজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার অ্যালকোহলের তুলনায় নিরাপদ’, এমন এক ধারণার জন্ম দেওয়ায় ডেভিড নাট তাঁর সরকারি পদ হারিয়েছিলেন ২০০৯ সালে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তামাকজাতীয় পণ্যের প্রচার করার ঘটনায় কয়েকটি তামাকবিরোধী সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ‘ভয়েস ফর ইন্টারঅ্যাক্টিভ চয়েস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট’ তাদের মধ্যে একটি।

ভয়েসের নির্বাহী পরিচালক আহমেদ স্বপন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ই-সিগারেটের পক্ষে প্রচারণাগুলো বিভ্রান্তিমূলক, গর্হিত এবং বাংলাদেশকে ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত করার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
তাপের মাধ্যমে ই-সিগারেট টিউবে ভেপ জুসের (প্রক্রিয়াজাত তামাকযুক্ত তরল পদার্থ) বাষ্প তৈরি ও তা সেবন করা হয়। ভেপিংয়ে প্রচলিত সিগারেট পানের তুলনায় বেশি মাত্রায় শ্বাস টানতে হয়।

স্বাস্থ্যের ওপর ই-সিগারেটের প্রভাব–সম্পর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ই-সিগারেটে ১৫ বার টান দিলে শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১৫ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম পর্যন্ত নিকোটিন ফুসফুসে প্রবেশ করে, যেখানে প্রচলিত সিগারেটে সমপরিমাণ শ্বাস নিলে ১ দশমিক ৫৪ থেকে ২ দশমিক ৬০ মিলিগ্রাম নিকোটিন নেওয়া হয়।
২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল টোব্যাকো এপিডেমিক প্রতিবেদনটি ই-সিগারেটকে স্বাস্থ্যের জন৵ হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কেননা, তামাক সেবনে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদ্‌যন্ত্র বিকল হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।

জন হপকিনস মেডিসিনের অন্তর্গত হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক মাইকেল ব্লাভা লিখেছেন, প্রাপ্ত তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে ই-সিগারেট ও প্রচলিত সিগারেট পানের অভ্যাস একই সঙ্গে চলতে থাকলে ফুসফুসের সমস্যা ও অ্যাজমা বা অন্যান্য হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে।

‘আপনি জানেন না বা বোঝেন না, ঠিক কোন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ (ভেপ জুসে বিদ্যমান) আপনি গ্রহণ করছেন। আদৌ সেগুলো নিরাপদ কি না, আপনি তা–ও জানেন না,’ ব্লাভা লিখেছেন জন হপকিনস মেডিসিনের ওয়েবসাইটে।

বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানিকারকদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান আছে, যারা ই-সিগারেট কিটস ও ভেপ জুস আমদানি ও বিপণন করে থাকে। এদের মধ্যে অনেকে অনলাইন শপও চালাচ্ছেন। কিটসের মূল্য ৪ হাজার ৫০০ টাকা ও তার অধিক এবং ৬০ মিলিলিটারের ভেপ জুসের সর্বনিম্ন মূল্য ৫০০ টাকা।

এই প্রতিবেদক এমনই বেশ কিছু ওয়েবসাইট খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে আমদানি করা ভেপ জুসের প্রদর্শনী ছিল।

প্রাপ্ত তথ্য এটাই প্রমাণ করে যে ই-সিগারেট ও প্রচলিত সিগারেট পানের অভ্যাস একই সঙ্গে চলতে থাকলে ফুসফুসের সমস্যা ও অ্যাজমা বা অন্যান্য হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
মাইকেল ব্লাভা, গবেষণা পরিচালক, হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধ কেন্দ্র, জন হপকিনস মেডিসিন

ভেপ জুস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ২১ বছরের কম নারী-পুরুষ এবং সন্তানসম্ভবা ক্রেতাদের উদ্দেশে সতর্কতা জারি করা আছে। কেননা, ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রচলিত ইনভায়রনমেন্টাল হেলথ হ্যাজার্ড অ্যাসেসমেন্টের ৬৫তম প্রস্তাবে বলা আছে, তরলীকৃত তামাক থেকে নির্গত ফরমালডিহাইড মানবশরীরে ক্যানসারের কারণ হতে পারে এবং নিকোটিন প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে।

বাংলাদেশে ই-সিগারেট পণ্য বিপণনকারী কোনো প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে এ ধরনের কোনো সতর্কবাণী নেই। যদিও তাদের সংগঠনের সভাপতি সুমন জামান বলছেন, তাঁরা ১৮ বছরের কম বয়সী কোনো ক্রেতার কাছেই পণ্য বিক্রি করেন না।

তামাকজাত পণ্যের প্রচারণা না করার স্বার্থে এই প্রতিবেদনে কোনো ই-সিগারেট পণ্যের নাম ও প্রাপ্তিস্থানের বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি।

বিগত কয়েক বছর ধরে ভেপ জুসের মান নিয়ে খোদ বিপণনকারীদের মধ্যেই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। কারণ, বাজারে চীনে উৎপাদিত যে ভেপ জুসগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর বেশির ভাগ ভেজাল বলে মনে করেন আমদানিকারকেরা। সুমন জামান এ ব্যাপারে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নজরদারি চান।

যথাযথ আইন না থাকায় বাংলাদেশে ই-সিগারেট আমদানি ও বিপণন নিষিদ্ধ নয়। একই কারণে কোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এই পণ্যের মান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় নেই।

জাতীয় হৃদরোগ ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও গবেষণাকেন্দ্রের চিকিৎসক অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেপিং তরুণদের মধ্যে তামাক আসক্তি বাড়াতে পারে। এ ধরনের আসক্তি ব্যাপক হারে ছড়ানোর আগেই সরকারের উচিত ই-সিগারেটকে নিয়ন্ত্রণ করা।’

২০১৯ সালে যখন ভারতে ই-সিগারেট নিষিদ্ধ করা হয়, তখন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের মাধ্যমে ই-সিগারেটকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয়। তবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে সে উদ্যোগ তখন সফল হয়নি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের সমন্বয়ক জিল্লুর রহমান চৌধুরী জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০১৯–এর উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পুনরায় আলোচনা শুরু করবে।