দেশে দেশে টিকা দিতে তোড়জোড়

করোনাভাইরাসের টিকার প্রতীকী ছবি
ছবি: রয়টার্স

করোনাভাইরাসের মহামারির শুরু থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নিরাপদ ও কার্যকর টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারই ধারায় মাত্র ১১ মাসে চলে আসে বেশ কয়েকটি টিকা। গত ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে যায় দেশে দেশে টিকা দেওয়া। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ কয়েকটি দেশে একাধিক টিকার অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩০টি দেশে করোনার টিকা অনুমোদন পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বেশির ভাগ দেশেই ফাইজারের টিকাটি অনুমোদন পেয়েছে। এ ছাড়া রুশ টিকা স্পুতনিক-ভি অনুমোদন পেয়েছে রাশিয়া, আর্জেন্টিনা ও বেলারুশে। এসব দেশে গত ডিসেম্বর থেকে টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে।

এর উল্টো চিত্র অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশগুলোয়। এসব দেশে করোনার টিকার প্রতীক্ষা এখনো শেষই হয়নি। কবে পৌঁছাবে টিকা, তারও নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।

আলোচনায় ছয় টিকা

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গত ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে এখন করোনার ২৩২টি টিকা নিয়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে ৬০টি টিকা মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে ৬টি টিকা। এগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও মডার্নার দুটি টিকা, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে উদ্ভাবিত টিকা, রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্ভাবিত টিকা স্পুতনিক-ভি, চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা ঘিরে সবচেয়ে বেশি আলোচনা চলছে। এ ছাড়া ভারতের প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেকের উদ্ভাবিত টিকাও এখন আলোচনায়। ফাইজারের টিকাটি উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেছে জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক।

বিশ্বে করোনার টিকার প্রথম অনুমোদন পায় যুক্তরাজ্যে। গত ৮ ডিসেম্বর থেকে দেশটিতে ফাইজারের টিকা দেওয়া শুরু হয়। এর কয়েক দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রেও তা অনুমোদন পায়। এর পরপরই দেশটিতে অনুমোদন পায় মডার্নার টিকা। যদিও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, রাশিয়া ও চীনে উদ্ভাবিত টিকা অনানুষ্ঠানিকভাবে এর আগে থেকেই দেওয়া শুরু হয়েছিল। রাশিয়া গত ১১ আগস্ট বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে স্পুতনিক-ভি টিকার অনুমোদন দেয়।

কার কাছে কত টিকা

বর্তমানে বিভিন্ন দেশে টিকা অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ছাড়াও কানাডা, মেক্সিকো, সৌদি আরব, বাহরাইন, ইসরায়েলসহ বিভিন্ন দেশ টিকার অনুমোদন ও প্রয়োগ শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গত ৩১ ডিসেম্বর ফাইজারের টিকাটি ব্যবহারে সম্মতি দিয়েছে। গত রোববার ভারতে অনুমোদন পায় অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ভারত বায়োটেকের টিকা। ভারতে অক্সফোর্ডের টিকাটি প্রস্তুত করছে দেশটির সেরাম ইনস্টিটিউট। সর্বশেষ গতকাল যুক্তরাজ্যে অক্সফোর্ডের উদ্ভাবিত টিকাটি দেওয়া শুরু হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে এখন করোনার ২৩২টি টিকা নিয়ে কাজ চলছে। এর মধ্যে ৬০টি টিকা মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপে রয়েছে। বর্তমানে আলোচনায় রয়েছে ৬টি টিকা।

তবে অভিযোগ উঠেছে, ধনী দেশগুলো টিকা কিনে হুমকিতে ফেলছে দরিদ্র দেশগুলোকে। পিপল’স ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামের একটি জোট সম্প্রতি বলেছে, ধনী দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। অথচ তারা টিকা কিনেছে মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ। পরিস্থিতি এখন এমন যে নিম্ন আয়ের দেশগুলো তাদের জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০ জনে একজনের বেশি টিকা দিতে পারবে না।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটির ডিউক গ্লোবাল হেলথ ইনোভেশন সেন্টারের তথ্যমতে, বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ পর্যন্ত ৭২৫ কোটি ডোজ টিকা আগাম কিনে রেখেছে। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ, ১৬০ কোটি ডোজ টিকা কিনেছে।

টিকা কেনায় ইইউর পরেই রয়েছে ভারত। দেশটি ১৫০ কোটি ডোজ টিকা কিনেছে। যুক্তরাষ্ট্র কিনেছে ১০০ কোটি ডোজ টিকা। এ ছাড়া কানাডা প্রায় ৩৬ কোটি ডোজ টিকা কিনে রেখেছে। অথচ দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি। সাড়ে ৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার দেশ যুক্তরাজ্য টিকা কিনেছে ৩৫ কোটি ৭০ লাখ ডোজ। জাপান টিকা কিনেছে ২৯ কোটি ডোজ। দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলের জনসংখ্যা প্রায় ২১ কোটি। দেশটি টিকা কিনেছে প্রায় ২০ কোটি ডোজ।

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা এ পর্যন্ত ৭২৫ কোটি ডোজ টিকা আগাম কিনে রেখেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সবচেয়ে বেশি পরিমাণ, ১৬০ কোটি ডোজ টিকা কিনেছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় ২০০ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। গত ৩১ ডিসেম্বর সংস্থাটির মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস এই তথ্য জানান। সমহারে করোনার টিকা বণ্টন নিশ্চিত করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভ্যাক্স কর্মসূচি চালু করেছে।
টিকা প্রয়োগের হারে এখন বিশ্বে সবার আগে রয়েছে ইসরায়েল। বার্তা সংস্থা এএফপির তথ্যমতে, ইসরায়েলে ১২ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। এর পরেই রয়েছে বাহরাইন। প্রায় ২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে সাড়ে ৩ শতাংশের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যে টিকা দেওয়া হয়েছে দেড় শতাংশের বেশি মানুষকে। যুক্তরাষ্ট্রে ১ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ কোটি। এ ছাড়া ডেনমার্ক, রাশিয়া, চীন, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশে চলছে জোরেশোরে টিকা দেওয়া। বেশির ভাগ দেশেই ফাইজারের টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে।

অবশ্য বাহরাইন ফাইজার ছাড়াও চীনের সিনোফার্মের টিকা কিনেছে। চীন আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে কয়েক কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এএফপি জানায়, শুধু চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে গত কয়েক দিনে প্রায় ৭৫ হাজার মানুষকে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়ে গেছে।

ইউরোপের দেশ ফ্রান্স অবশ্য এখনো টিকা দেওয়া শুরু করেনি। তবে রয়টার্স জানায়, ফ্রান্সে অচিরেই মডার্নার টিকা দেওয়া শুরু হবে বলে গতকাল সোমবার দেশটির ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা জানিয়েছে। টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ায় ফ্রান্সে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে।