দেশে-বিদেশে শুধু ঘাটতির কথা বললে হবে না, অর্জনের কথাও বলবেন: গওহর রিজভী

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে অতিথিরা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র, ১৩ ডিসেম্বর
ছবি: সাজিদ হোসেন

প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছেন, এনজিও, সুশীল সমাজসহ সবাই এগিয়ে এসেছে বলেই গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ এত দূর অগ্রসর হয়েছে। সংবিধানে দেওয়া অনেক অধিকার এখনো অর্জন হয়নি, সবার সহায়তা ছাড়া এটা পূরণ হবে না। বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইন পাস করা, মাইনরিটি রাইটস কমিশন বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার কমিশন গঠনেও সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

আজ সোমবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন উপলক্ষে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) আয়োজিত সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গওহর রিজভী এ কথা বলেন।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এনজিও ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাজের প্রশংসার পাশাপাশি গওহর রিজভী বলেন, ‘গত ৫০ বছর এবং বর্তমান সরকারের ১৩ বছরের অর্জন অনেক। ঘাটতিও কিছু আছে। তবে আমরা অর্জন যেন ভুলে না যাই। দেশে-বিদেশে শুধু ঘাটতির কথা বললে হবে না, অর্জনের কথাও বলবেন।’

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার পর গণমাধ্যমকর্মীরা প্রশ্ন করলে উত্তর দেননি উপদেষ্টা গওহর রিজভী। তিনি বলেন, দেশের বাইরে ছিলেন, মাত্র দুই দিন আগে দেশে ফিরেছেন। তাই সাম্প্রতিক কোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে দুর্গাপূজায় সহিংসতাবিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রীর এই উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা মাইনরিটি রাইটস কমিশন করব। সরকারের ১৩ বছরে দেখেছেন, কেমন পূজা হয়েছে। সম্মিলিতভাবে সবাই পূজা করেছেন। এবার কিছু গন্ডগোল হয়েছে। কারা করেছে তার তদন্ত চলছে। যারা করছে তাদের ধরা হচ্ছে। তাই সরকারের ১৩ বছরের রেকর্ড আপনারা দেখতে পারেন।’

সংগ্রামে শপথে মানবাধিকার-স্লোগান নিয়ে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো–অপারেশন এসডিসি, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-সিডা, সুইডেন সোয়ারিয়া, ইউকে এইডের সহায়তায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ শতাধিক মানুষ অংশ নেন। তৃণমূল পর্যায়ের প্রতিনিধিরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিজেদের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেন।
সৈয়দপুর-নীলফামারীর পল্লীশ্রীর কিশোরী দলের সদস্য আদুরী আক্তার জানাল, তার বাল্যবিবাহ এবং তারপর নির্যাতন থেকে বাঁচতে তালাক হওয়ার কাহিনি। আদুরী বলে, ‘বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কাজ করলেও নিজে বিয়েটাই ঠেকাতে পারি নাই। করোনার শুরুতে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা-মা বিয়ে দেয় ৪০ বছর বয়স্ক একজনের সঙ্গে। স্কুলসহ বিভিন্ন সংস্থা বন্ধ, মুঠোফোনও আটকে রাখায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। বিয়ের পর বাবার বাড়িতে ছিলাম, ওই লোক আসছে শুনলেই বান্ধবীর বাড়িতে লুকিয়ে থাকতাম। একসময় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে থাকতে বাধ্য হলাম। তারপর শুরু হয় নির্যাতন।’

আদুরী বলে, ‘স্বামী আমাকে যেভাবে চাইতেন তা পূরণ করতে পারতাম না। তখন মনে হতো, বেঁচে থেকেও আমি মরে গেছি। তারপর পল্লীশ্রী সংগঠনের আপাদের মাধ্যমে বাবা-মাকে অবশেষে আমার অবস্থা বোঝাতে পারি। তারপর তালাকের ব্যবস্থা করেন। আবার পড়াশোনা শুরু করে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আমি চাই, আমার মতো আর একটি মেয়েও যেন কষ্ট না পায়।’

সম্মেলনে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, এ ধরনের শত শত আদুরী আছে। তবে এই আদুরীদের পরিসংখ্যান সরকারের কাছে নেই। বাল্যবিবাহ পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করতে হবে। আর বাল্যবিবাহের শিকার মেয়েদের যে করেই হোক আবার স্কুলে ফিরিয়ে আনতে হবে।

সম্মেলনে সংহতি প্রকাশ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্জন অনেক। আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। তবে এটা শুধু অর্থনৈতিক স্বপ্ন নয়, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, মর্যাদা অনেক কিছু এর সঙ্গে জড়িত।’

সম্মেলনের সভাপতির বক্তব্য ও স্বাগত বক্তব্যে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, করোনায় প্রান্তিক জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেক বেশি, পিছিয়েও গেছে তারা। নতুন দারিদ্র্য তৈরি হয়েছে। সমাজে বৈষম্য-অসমতা বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে করোনায় নারীদের জীবনে বেশি প্রভাব ফেলেছে। কাজের চাপ বেড়েছে, বাল্যবিবাহ, পারিবারিক নির্যাতনসহ বিভিন্ন নির্যাতন বেড়েছে। সরকারের পাশাপাশি সবাই মিলে করোনাকে সামাল দিতে পেরেছে, এখন বৈষম্য দূর করার দিকে নজর বাড়াতে হবে।

এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম তারিকুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বের মতো নানা ধরনের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস ২০২১। দিবসটি উপল‌ক্ষে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার সঙ্গে থাকতে পেরে তিনি আনন্দিত। কারণ, পুরো দেশ থেকে আসা মানবাধিকারকর্মীদের এই সম্মিলন মানবাধিকার অর্জনের ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

সম্মেলনে বক্তাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনার পাশাপাশি ১৯ বছর ধরে কাজ করা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নানা সাফল্য পটগানের মাধ্যমে তুলে ধরেন খুলনার রূপান্তর শিল্পীগোষ্ঠীর সদস্যরা। হিজড়া জনগোষ্ঠীর পরিবেশনায় ফ্লাশমব, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যদের নৃত্য, সিআরপি বা পক্ষাঘাতগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রের হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের নৃত্যসহ বিভিন্ন পরিবেশনা সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা উপভোগ করেন। সম্মেলন শুরু হয় জাতীয় সংগীত এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের থিম সং দিয়ে। খুলনার পাইকগাছার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য অঞ্জলী ঢালী, সাতক্ষীরার বল্লী ইউনিয়ন সামাজিক উদ্যোগ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মুনছুর আলী, বরগুনার নজরুল স্মৃতি সংঘ নারী দলের সদস্য লাইলী বেগম, গাইবান্ধার অলিভিয়া হেমব্রেম নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

সম্মেলনে সাংসদ আরমা দত্ত, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক কে এম তারিকুল ইসলাম, বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটারটন ডিকসন, বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত অ্যালেক্স বার্গ ফন লিন্ডে, বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইস রাষ্ট্রদূত নাথালি চুয়ার্ড প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন। তাঁরা বলেন, মানুষের অধিকার অর্জনের মাধ্যমেই দেশের গণতন্ত্র সমুন্নত হবে।

সম্মেলনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম ভিডিও বার্তায় মানবাধিকার রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, দেশের অনেক অর্জন আছে। তবে নারীর প্রতি সহিংসতা কমেনি। ধর্ষণের কারণে বিভিন্ন অর্জন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।