দেশে ভালো নেই অভিবাসী মায়েদের সন্তানেরা

  • বছরে বিদেশে যান লাখের বেশি নারী

  • ৯০ শতাংশ নারী দেশে শিশুদের রেখে যান

  • আয়ের ৮৩ শতাংশ দেশে পাঠান নারীরা

  • বিভিন্ন রোগে ভোগে ৭০ শতাংশ শিশু

  • বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে ৩২ শতাংশ

সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য তাদের দেশে রেখে কাজ নিয়ে বিদেশে যান মায়েরা। অভিবাসী নারী কর্মীরা কষ্টের উপার্জনের বেশির ভাগটাই পরিবারের জন্য দেশে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু ভালো নেই অভিবাসী এই মায়েদের সন্তানেরা। অযত্নে বড় হচ্ছে তারা। স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। অসুখেও ভোগে। মায়েরা ভরসা করে যে অভিভাবকের কাছে সন্তানদের রেখে যান, তাঁদের কাছেই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হয় ৬০ শতাংশ শিশু। বেসরকারি একটি সংস্থার পরিচালিত গবেষণা জরিপে এসব তথ্য জানা গেছে।

গ্রামে রেখে যাওয়া শিশুদের ওপর নারী অভিবাসনের প্রভাব যাচাই করতে গবেষণা জরিপটি পরিচালনা করেছে অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম (ওকাপ)। ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার চরহরিরামপুর, চরভদ্রাসন ও গাজীরটেক ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় গবেষণা জরিপটি চালানো হয়। এসব প্রত্যন্ত এলাকায় অবকাঠামোগত ও সামাজিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।

জরিপ বলছে, বিদেশ থেকে পাঠানো নারী অভিবাসী কর্মীর আয়ে ৮০ শতাংশ পরিবারের আর্থিক উন্নতি হয়েছে। এসব পরিবার বাসস্থান, খাবার, চিকিৎসা ও শিশুদের শিক্ষায় আগের চেয়ে বেশি ব্যয় করছে। কিন্তু অবস্থা বদলায়নি অভিবাসী মায়ের সন্তানদের। স্থানীয় অভিভাবকের বাসায় ৬৩ শতাংশ মেয়েশিশুকে বিভিন্ন কাজ করতে হয় এবং ৮৩ শতাংশ ছেলেশিশুকে বাসার বাইরে কাজ করতে হয়।

এমনই একজন ফরিদপুরের চরহরিরামপুর ইউনিয়নের যুঁথী। সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। দুই বছর ধরে জর্ডান থাকেন তার মা। যুঁথী প্রথম আলোকে বলে, ‘সে গ্রামে বাবা ও দাদির সঙ্গে থাকে। বাসার সব কাজ করতে হয়। দাদি প্রায়ই বলেন, পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে।’

গবেষণা জরিপ প্রতিবেদন বলছে, দিনে গড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টা বাসার কাজ করে শিশুরা। প্রতিদিন এসব কাজ করতে ভালো না লাগলেও নির্যাতনের ভয়ে তারা কাজ করতে বাধ্য হয়। এসব শিশুদের মধ্যে বাল্যবিবাহ খুব নিয়মিত বিষয়। অনেক মেয়েশিশুকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেন স্থানীয় অভিভাবকেরা। বিয়ের পর মেয়েশিশুদের দ্রুত অভিবাসী কর্মী হিসেবে কাজে পাঠানো হয়। যাতে তারা স্বামীর জন্য আয় করতে পারে।

প্রতিবেদনে জানা যায়, কয়েকটি শিশু স্বজনদের কাছে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। ভয়ে সব বিষয় তারা বলেনি।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, ১৯৯১ সাল থেকে নারীরা কাজ নিয়ে বিদেশে যেতে শুরু করেন। ২০০৩ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে বিদেশে গেছেন ১ হাজার ৪৭৯ নারী। এরপর এটি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কয়েক বছর ধরে লাখের বেশি নারী কর্মী যাচ্ছেন বিদেশে। এ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৯ লাখ নারী কাজ নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। আর ৯০ শতাংশ নারী দেশে তাঁদের শিশুদের রেখে যান বলে ধারণা করছে ওকাপ।

৪০০ পরিবারে পরিচালিত জরিপটি ৩ মার্চ প্রকাশ করেছে ওকাপ। এর মধ্যে ২৫০ অভিবাসী নারী কর্মীর পরিবার। বাকি ১৫০ পরিবারে অভিবাসী নেই। জরিপে ৬ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু ও তাদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। যেসব নারী কর্মী অনেক দিন ধরে বিদেশে আছেন এবং নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন, শুধু তাঁদের পরিবারকে গবেষণা জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে ৩২ শতাংশ শিশু

বিদেশে যাওয়ার পর অল্প সময়ের ব্যবধানে ৪০ শতাংশ মেয়ে ও ৪৮ শতাংশ ছেলেশিশু বিদ্যালয়ে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, এর পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। অন্যতম কারণ হলো, বেতন বা বেতন ছাড়া শিশুদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করান স্থানীয় অভিভাবকেরা। তাঁরা চান শিশুরা স্কুলে না গিয়ে বাসায় কাজ করুক। মা কাছে না থাকায় অনেক শিশু একাকিত্ব ও বিষণ্নতায় ভোগে। এ কারণেও অনেকে স্কুলে যেতে চায় না। ১৬ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৩২ শতাংশ শিশু স্কুল থেকে ঝরে পড়ে। ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিশুদের স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বেশি।

চরহরিরামপুর ইউনিয়নের ১১ বছর বয়সী সোনিয়া দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। এরপর তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। সোনিয়া জানায়, তিন বছর ধরে তাঁর মা লেবাননে আছে। শুরুতে নিয়মিত টাকা পাঠালেও এখন আর পারছে না। বাবা মারা গেছে। থাকে নানির সঙ্গে। বাসার সব কাজ সামলাতে গিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণির পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে।

কতজন বিদেশে গেল, কত টাকা দেশে এল, শুধু এ হিসাব করা হলে অভিবাসনের সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন করা হয় না। নারী কর্মীদের রেখে যাওয়া শিশুদের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় এনে কর্মসূচি নিতে হবে। বাজেটে অভিবাসী পরিবারের উন্নয়নে আলাদা বরাদ্দ থাকাটা জরুরি
শাকিরুল ইসলাম , ওকাপ চেয়ারম্যান

বিভিন্ন রোগে ভোগে ৭০%

গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, বিদেশে থাকা নারী কর্মীর শিশুদের মধ্যে ৭০ শতাংশ সর্বশেষ এক বছরে বিভিন্ন রোগে ভুগেছে। কিন্তু দেশে থাকা মায়ের শিশুদের রোগে আক্রান্তের হার ৩০ শতাংশ। যত্নের অভাবেই এমনটা হয়। অভিবাসী মায়েদের শিশুদের ৬১ শতাংশকে রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাসেবা নিতে হয়েছে। আর দেশে মায়ের কাছে থাকা শিশুর মধ্যে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৯ শতাংশ। অভিবাসী মায়ের পাঠানো অর্থের মধ্যে ১০ শতাংশেরও কম ব্যয় হয় শিশুর স্বাস্থ্যসেবায়। ২০ শতাংশ ব্যবহার হয় পরিবারের খাবার জোগাতে। তবে উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে খাবারে পুষ্টিমান রক্ষা করা হয় না।

চরহরিরামপুরের থাকে ১৩ বছরের সুমাইয়া আকতার। সে জানায়, ৭ বছর ধরে লেবাননে থাকে তাঁর মা। মাঝে দুবার দেশে এসেছে। সুমাইয়া বাবার সঙ্গে থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি বাসার সব কাজ করে। সব সময় মন খারাপ থাকে, একাকিত্বে ভোগে। একই অবস্থা সৌদিপ্রবাসী মায়ের সন্তান ঝর্নারও।

সামাজিক প্রভাব যাচাই হয় না

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিবাসী নারী কর্মীদের রেখে যাওয়া শিশুদের নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেই। গবেষণা জরিপ বলছে, ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ৯০ শতাংশ একাকিত্বে ভোগে।

অভিবাসী নারী কর্মীদের দেশে রেখে যাওয়া শিশুদের কল্যাণে গবেষণা জরিপ প্রতিবেদনে সরকারের কাছে কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে দেওয়া মেধা বৃত্তির আওতা আরও বাড়িয়ে ঝরে পড়া শিশুদের সহায়তা করা যেতে পারে। বেসরকারি সংস্থা ও নাগরিক সমাজকে যুক্ত করে স্থানীয় পর্যায়ে শিশুদের জন্য বিভিন্ন সুবিধা চালু করতে পারে।

এ বিষয়ে ওকাপ চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কতজন বিদেশে গেল, কত টাকা দেশে এল, শুধু এ হিসাব করা হলে অভিবাসনের সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন করা হয় না। নারী কর্মীদের রেখে যাওয়া শিশুদের বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় এনে কর্মসূচি নিতে হবে। বাজেটে অভিবাসী পরিবারের উন্নয়নে আলাদা বরাদ্দ থাকাটা জরুরি।