দেশের ৭২% মানুষ সরকারি দুর্নীতিকে ‘বড় সমস্যা’ মনে করেন

বাংলাদেশসহ এশিয়ার ১৭ দেশের ২০ হাজার নাগরিকের ওপর জরিপ চালিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)

আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) নিজেদের ওয়েবসাইটে ‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-এশিয়া ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ছবি: ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

বাংলাদেশের ৭২ শতাংশ মানুষ মনে করেন, সরকারি দুর্নীতিই সবচেয়ে ‘বড় সমস্যা’।গত ১২ মাসে যাঁরা সরকারি সেবা নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ২৪ শতাংশ মানুষ একবারের জন্য হলেও ঘুষ দিয়েছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘গ্লোবাল করাপশন ব্যারোমিটার-এশিয়া ২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) গত মঙ্গলবার নিজেদের ওয়েবসাইটে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। মূলত এশিয়া অঞ্চলের ১৭টি দেশের ওপর চালানো জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। এসব দেশের মোট ২০ হাজার নাগরিকের ওপর এই জরিপ চালানো হয়। ২০১৯ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই জরিপ পরিচালিত হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ১৭টি দেশের মধ্যে এক-চতুর্থাংশে একনায়ক শাসনব্যবস্থা চালু আছে। সেসব দেশে জনগণের নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার যেমন সীমিত, তেমনি সীমিত বাকস্বাধীনতাও। জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের প্রতি চারজনে একজন বলেছেন, তাঁদের দেশে দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা। এই প্রতিবেদনে সার্বিকভাবে দেখা গেছে যে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনে একজন সরকারি সেবা নিতে গিয়ে ঘুষ দিয়েছেন।

বাংলাদেশের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বিদ্যমান সরকারি সেবাগুলোর মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় নাগরিকদের। শতাংশের হিসাবে তা হলো ৩৭%। আবার সংস্থার দুর্নীতির হিসাবে স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় ৩৫ শতাংশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবির) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। প্রকাশিত প্রতিবেদনে সেই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে।

দেশে বিদ্যমান সরকারি সেবাগুলোর মধ্যে পুলিশের কাছ থেকে সেবা নিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘুষ দিতে হয় নাগরিকদের। শতাংশের হিসাবে তা হলো ৩৭%। আবার সংস্থার দুর্নীতির হিসাবে স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে হয় ৩৫ শতাংশ।

সার্বিকভাবে সরকারি দুর্নীতিকে ‘বড় সমস্যা’ বলে মনে করেন, এমন মানুষের সংখ্যার দিক থেকে সবার ওপরে আছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটির প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ এমনটা মনে করেন। তাইওয়ানের ৯১ শতাংশ এবং মালদ্বীপের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তাঁদের দেশে সরকারি দুর্নীতি অন্যতম বড় সমস্যা। ভারতে এটি ৮৯ শতাংশ। তুলনামূলক নিজ দেশে সরকারি দুর্নীতিকে বড় সমস্যা মনে করেন না কম্বোডিয়া (৩৩%) ও মিয়ানমারের (৫০%) মানুষ।

এ ছাড়া এশিয়াজুড়ে প্রতি চারজনে একজন মানুষ তাঁদের দেশের দুর্নীতি দমন সংস্থার নামের সঙ্গে পরিচিত। এর মধ্যে সার্বিকভাবে ৬৩ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তাঁদের দেশের দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বেশ ভালো কাজ করছে। স্থানীয় দুর্নীতি দমন সংস্থায় আস্থা রাখার দিক থেকে এশিয়ার ১৭টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মিয়ানমার। দেশটির প্রায় ৯৪ শতাংশ মানুষ তাঁদের জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী সংস্থায় আস্থা রাখেন। তবে দেশটিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দমনে যেমন সুষ্ঠু তদন্তে জোর দেওয়া হয়, সেই তুলনায় সামরিক কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয় বলে উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা। দুর্নীতি দমন সংস্থায় আস্থা রাখার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের পরই অবস্থান বাংলাদেশের। এ দেশে দুর্নীতি দমন সংস্থায় আস্থা রাখেন ৮৬ শতাংশ মানুষ।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। প্রকাশিত প্রতিবেদনে সেই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

এ বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমি আনন্দিত যে এ রকম একটা প্রতিবেদন এসেছে। এবারের (আগামী ৯ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্যই হচ্ছে ট্রুথ, ট্রাস্ট অ্যান্ড ট্রান্সপারেন্সি। ইনস্টিটিউশনগুলোকে বাঁচিয়ে রাখে কিন্তু এই আস্থা (ট্রাস্ট)। জনগণকে সেবা দিয়েই আস্থা অর্জন করতে হয়। আমরা সেই চেষ্টাই করেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘দুর্নীতি হচ্ছে, দুর্নীতি আছে—এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। গত চার–পাঁচ বছরে সরকারি খাতে দুর্নীতি কমছে। তবে সেটা জন-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কমেনি। দুর্নীতি প্রতিরোধে সবাইকে যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে সচেতন হতে হবে।’

সার্বিক জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৩৮ শতাংশ মনে করেন, দুর্নীতি বাড়ছে। আর ২৮ শতাংশ মনে করেন, দুর্নীতি আগের মতোই আছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যদিও জনসাধারণ সরকারি দুর্নীতিকে বড় সমস্যা বলে মনে করছে, তবে একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সরকার এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেসব ব্যবস্থা নিচ্ছে, তাতে তাদের সমর্থনও রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৬১ শতাংশ মনে করেন, তাঁদের সরকার দুর্নীতি সামাল দিতে ভালো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। আবার জরিপে এ-ও দেখা গেছে যে সার্বিকভাবে ৩২ শতাংশ নাগরিক মনে করেন, বেশির ভাগ বা সব সংসদ সদস্যই দুর্নীতিতে জড়িত থাকেন।

ড. ইফতেখারুজ্জামান অবশ্য দেশে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর ৮৬ শতাংশ মানুষের আস্থার বিষয়ে ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। তাঁর মতে, এখানে আস্থাটা কোন অর্থে—সেটা বিবেচনার বিষয়। এক অর্থে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর মানুষ নির্ভরশীল। কারণ, দুর্নীতি প্রতিরোধে আইনগত প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব তাঁদের। সে কারণে দুদকের ওপর মানুষ নির্ভর করে, আস্থা রাখতে চায়। আর এই জরিপ হয়েছে টেলিফোনে, যেখানে মানুষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষণশীল থাকেন। এ ক্ষেত্রে সেটার প্রতিফলন ঘটে থাকতে পারে।