দেড় লাখ আবেদন ঝুলে আছে

এনআইডি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সিংহভাগ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আসা: ইসি

প্রতীকী ছবি

সাভারের বাসিন্দা শামসুন্নাহারের স্বামীর নাম জালাল উদ্দিন। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) স্বামীর নাম ছাপা হয়েছে হালাল উদ্দিন। এই ভুল সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ দিয়ে তিনি ২০১৫ সালের ১০ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছিলেন। ৫ বছর ৪ মাস পার হলেও তিনি সংশোধিত পরিচয়পত্র হাতে পাননি। জাতীয় পরিচয়পত্রে ভুল থাকায় তিনি একটি ব্যাংক হিসাবও খুলতে পারছেন না।

ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬৪টি সংশোধনী আবেদন জমা পড়ে আছে। এর বাইরে গত বুধবার পর্যন্ত ৬৯ হাজার ৫১৩টি আবেদন ঝুলে ছিল শ্রেণি নির্ধারণের অপেক্ষায়। চার শ্রেণিতে ভাগ করে আবেদন নিষ্পত্তি করে ইসি।

ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সাভারের সেই শামসুন্নাহারের কোনো সংশোধনী আবেদন ইসির সার্ভারে নেই। তিনি আবেদন জমা দিয়েছিলেন ইসির সাভার থানা কার্যালয়ে। সেখান থেকে দেওয়া রসিদও তাঁর কাছে আছে। পাঁচ বছরে একাধিকবার তিনি সেখানে গিয়ে খোঁজখবরও করেছেন। হচ্ছে, হবে করে তাঁকে বুঝ দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু ইসি সূত্র প্রথম আলোকে বলছে, শামসুন্নাহারের আবেদনটি আসলে হারিয়ে গেছে বা কোনো গাফেলতির কারণে ইসির সার্ভারে এই তথ্য ইনপুট দেওয়া হয়নি। এ ধরনের ঘটনাও নাকি একেবারে কম নয়।

খোদেজা আক্তার নামের একজন ভোটার নিবন্ধনের সময় জন্ম সাল লিখেছিলেন ১৯৯২। কিন্তু ইসির কর্মীরা তথ্য সার্ভারে তুলতে গিয়ে লিখেছেন ১৯৬৯। এটা সংশোধনের জন্য ২০১৭ সালে তিনি আবেদন করেছিলেন। এখন পর্যন্ত সংশোধিত পরিচয়পত্র তিনি হাতে পাননি।

ইসির বিধিমালা অনুযায়ী, আবেদনের তারিখ থেকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে কমিশন সন্তুষ্ট হলে সংশোধন করে তা আবেদনকারী বা তাঁর আইনানুগ অভিভাবককে জানানোর কথা। আবেদন নামঞ্জুর হলে সেটিও যথাশিগগির আবেদনকারীকে জানানোর কথা।

নির্বাচন কমিশন

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যার দিক থেকে দেড় লাখ অনেক বড়। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। একই সঙ্গে অনেকে নানা ধরনের অনিয়ম, অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেন। যে কারণে আইনকানুন খুব কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। তিনি বলেন, কিছু অনিয়ম থাকতে পারে। তাঁরা চেষ্টা করছেন যতটুকু সম্ভব দ্রুত সংশোধনের কাজ শেষ করতে।

এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ১১ কোটির বেশি ভোটারকে ইসি সেবা দেয়। এনআইডি ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রয়োজন। শুরুতে এটি ছিল না, এখনো পূর্ণাঙ্গ কাঠামো নেই। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের সিংহভাগ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আসা। জাতীয় পরিচয়পত্রের সেবার কাজটি সুচারুভাবে করতে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল, অবকাঠামো ও তথ্যপ্রযুক্তিগত উন্নয়ন প্রয়োজন। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করার সুযোগ আছে কি না, সেটাও দেখা প্রয়োজন।

২৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে এনআইডি সংশোধনে হয়রানি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন সরকারি দলের সাংসদ মোজাফ্‌ফর হোসেন। জবাবে সংসদ কাজে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, সংশোধনের জন্য প্রাপ্ত আবেদনসমূহের চাওয়া অনেক ক্ষেত্রে অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত। ফলে ওই সব আবেদন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে যথাযথ প্রমাণপত্র/দলিলাদি দাখিলসহ ক্ষেত্রবিশেষ তদন্ত, পুনঃ তদন্তের প্রয়োজন পড়ে। দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ কারণে বিশেষ করে সাংবাদিক মহল বিরাগভাজন হয় এবং এ-সংক্রান্ত সেবা সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে, যা সম্পূর্ণ সত্য নয়।

আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, কয়েক বছর ধরে লক্ষ করা যাচ্ছে, কিছু কিছু নাগরিক উদ্দেশ্যমূলকভাবে জন্মতারিখ পরিবর্তন করতে আবেদন করে থাকেন, যা একেবারেই অযৌক্তিক। একই ব্যক্তি নিবন্ধনকালে একটি জন্মতারিখ দেন, আবার সংশোধনের জন্য ভিন্ন জন্মতারিখ উল্লেখিত জন্মসনদ/উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়/কারিগরি/মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সনদ জমা দিয়ে জন্মতারিখের পরিবর্তন চান, যা সংশোধনের ক্ষেত্রে জটিলতার সৃষ্টি করে এবং ওই সনদে উল্লেখিত বয়সের সঙ্গে ব্যক্তির বাস্তবিক বয়সের মিল থাকে না।

অনেকে নানা ধরনের অনিয়ম, অবৈধ সুবিধা নেওয়ার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করেন। যে কারণে আইনকানুন খুব কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়
শাহাদাত হোসেন চৌধুরী, নির্বাচন কমিশনার

ইসি সূত্র জানায়, একদিকে সব প্রয়োজনীয় কাগজ ও দলিল থাকা সত্ত্বেও যেমন অনেকে এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে ভোগান্তির মধ্যে আছেন, অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য দিয়েও অনেকে সহজেই একাধিক এনআইডি করছেন বা পরিচয়পত্র সংশোধন করছেন। আবার অনেকে বিভিন্ন ভাতা, জমিজমা দখল, চাকরিতে সুবিধা নেওয়াসহ নানা কারণে ভুয়া প্রমাণক তৈরি করে জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন করাচ্ছেন।

জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নামের বানানের সংশোধনী বড় কোনো বিষয় নয়। কিন্তু যদি নামের আমূল পরিবর্তন, বয়স ৫-১০ বছর বাড়ানো-কমানোর আবেদন হয়, তাহলে তদন্তের বিষয় থাকে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে আবেদন ঝুলিয়ে রাখা ঠিক নয়। এখন যেসব আবেদন ঝুলে আছে, সেগুলোর নিষ্পত্তির জন্য একটি বোর্ড গঠন করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।