দেড় হাজার পুঁথির গায়ে বহুকালের ধুলা

মধ্যযুগের অমূল্য ভান্ডার দেড় হাজার পুঁথি পুরোপুরি নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে। পুঁথি রক্ষার চেয়ে প্রকল্প পাসে বেশি জোর।

লাল শালুতে মোড়ানো পুঁথিগুলোতে জমেছে ধুলার আস্তরণ। গত ৩০ মে রাজধানীর বাংলা একাডেমির সংগ্রহশালায়
ছবি: প্রথম আলো

‘যত্নে থাকবে পুত্রের মতো, বাঁধতে হবে শত্রুর মতো’—বহুকালের পুরোনো প্রবাদটি পুঁথি নিয়ে। বাতাস প্রবেশ রোধে লাল শালুতে বাঁধা আছে ঠিকই, তবে অতি অযত্নে পুরোপুরি নষ্ট হতে বসেছে বাংলা একাডেমির সংগ্রহে থাকা প্রায় দেড় হাজার পুঁথি।

এই সংগ্রহশালায় থাকা ১ হাজার ৫৩৬টির মধ্যে অধিকাংশ পুঁথির অবস্থাই নাজুক। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা একমাত্র কর্মচারী আবদুল মান্নান জানালেন, পাঠক বেশি খুঁজতে আসেন পদ্মাবতী ও নূরনামা পুঁথি দুটি। পদ্মাবতীর অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও নূরনামার চলছে অন্তিমকাল। স্টিলের শেলফ আর কাঠের আলমারিতে রাখা অবিন্যস্ত পুঁথিগুলো আছে লাল শালুতে মোড়ানো। এর ভেতর হার্ডবোর্ড বা কাঠখণ্ড ব্যবহার করে চাপা দেওয়া পুঁথিগুলো আছে পুরোনো কাগজের মোড়কে। অধিকাংশ পাণ্ডুলিপির পাতা ওলটানোর অবস্থা নেই। প্রতিটি ধাপেই বহুকালের ময়লা ও ছত্রাকের জয়জয়কার।

লিপির পাঠোদ্ধার, সংরক্ষণ ও ডিজিটাল মহাফেজকরণের পরিকল্পনা নিয়ে সাড়ে ২২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। ২০২৩ সালের জুনের আগে এ প্রকল্প নিয়ে কোনো অগ্রগতি হবে না বলেই মনে করে একাডেমি কর্তৃপক্ষ। তাহলে এই সময়ের মধ্যে সংরক্ষণের ব্যবস্থা কী? বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বললেন, ‘গত ১০–১৫ বছরে অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে।

আগের দায়িত্বরত ব্যক্তিরা পুঁথি বা পাণ্ডুলিপি নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন বলে মনেই হয় না। প্রকল্প পাসের পর অর্থ বরাদ্দ হলে যত দ্রুত সম্ভব ডিজিটাইজ করার চেষ্টা করা হবে। আপাতত প্রতিদিন সকালে হালকা বাতাসের মাধ্যমে পরিষ্কারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পুঁথিগুলোর এখন যে অবস্থা, তাতে খুলে পরিষ্কার সম্ভব নয়। যেটুকু আছে, তা–ও নষ্ট হবে।’

খবর নিয়ে জানা গেল, পালক দিয়ে পুঁথিগুলোর ধুলা ঝাড়া হয় শুধু বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে। একাডেমির নির্মাণশ্রমিকদের দিয়ে অদক্ষভাবে পরিষ্কার করানোর অভিযোগও রয়েছে। পাণ্ডুলিপিগুলো মোড়ানো ১৯৬৪ সালের পত্রিকা দিয়ে। কোনো কোনোটির গায়ে সেঁটে গেছে পুরোনো পত্রিকার কালি। বর্ধমান হাউসের এ কক্ষটি ভ্যাপসা।

কয়েকটি সিলিং ফ্যান ছাড়া তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। অথচ একটি ‘ডি-হিউমিডিফায়ার’ বা আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণযন্ত্র বাধ্যতামূলক, যার মূল্য এক লাখ টাকারও কম। নেই একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনার পর্যন্ত। সংরক্ষণাগার থেকে বের হলেই হাতের ডানে তিন হাত দূরে শৌচাগার। পুরো স্থানটিই স্যাঁতসেঁতে থাকে ১২ মাস।

‘গবেষণা, সংকলন, অভিধান ও বিশ্বকোষ’ বিভাগের অধীনে গবেষণা উপবিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পুঁথি সংগ্রহশালা। নিয়ম অনুযায়ী, প্রকল্প প্রস্তাব ওই বিভাগের পরিচালকের তৈরি করার কথা থাকলেও তা বানিয়েছেন ‘অনুবাদ, পাঠ্যপুস্তক ও আন্তর্জাতিক সংযোগ’ বিভাগের পরিচালক মো. হাসান কবীর। এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্বে না থাকলেও সম্প্রতি পুঁথির অবস্থা দেখে মনে হয়েছে, এখনই উদ্যোগ না নিলে মধ্যযুগের এই মূল্যবান ইতিহাসের আর কিছুই রক্ষা করা যাবে না। মহাপরিচালকের পরামর্শে তাই প্রকল্প প্রস্তাব কাজটির দায়িত্ব নিতে হয়েছে।’

একাডেমির সংগ্রহে প্রায় দেড় হাজার পুঁথি থাকলেও সবশেষ ১৯৯৫ সালে তৈরি তালিকায় আছে ৫৮১টির উল্লেখ। সুকুমার বিশ্বাসের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত বাংলা একাডেমী পুঁথি পরিচয়-১ একমাত্র গ্রন্থটিকেও অসম্পূর্ণ বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। অর্থাৎ এখানকার দেড় হাজার পুঁথি নিয়ে সঠিক ধারণা পাওয়ার কোনো সুযোগটুকুও গত তিন দশকে তৈরি করতে পারেনি বাংলা একাডেমি।

গত ৩০ মে সংরক্ষণাগারে প্রবেশ করা হয় তালা খুলিয়ে। কোনো ছাত্র বা গবেষকের উপস্থিতি নেই কেন, জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ প্রথম আলোকে জানায়, ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি। গবেষণা করতে হলে প্রয়োজন হয় বিশেষ অনুমতির। এ নিয়ে সম্প্রতি তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র। পুঁথি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে কয়েক দফায় আবেদন করে বিফল হয়েছেন। অতঃপর একজন পরিচালকের সঙ্গে সরাসরি দেখা করতে গেলে তাঁকে বের হয়ে যাওয়ার আদেশ দিয়ে পুঁথি কক্ষে তখনই তালা লাগানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিভাগ সম্প্রতি তাদের অনেক পুরোনো পুঁথি ও পাণ্ডুলিপি ডিজিটাইজ করেছে। এ প্রসঙ্গে তাদের অভিজ্ঞতা জানতে গেলে বেরিয়ে আসে আরেকটি তথ্য। বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক প্রয়াত শামসুজ্জামান খানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিভাগের পক্ষ থেকে ২০১৬–১৭ সালে মৌখিকভাবে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, পুরোনো পাণ্ডুলিপি ও পুঁথি ডিজিটাইজ করে দেওয়ার।

কিন্তু তিনি জানিয়েছিলেন, একাডেমি নিজেদের সক্ষমতায় কাজটি সম্পন্ন করবে। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের নিজস্ব স্ক্যানার ব্যবহার করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিরও কিছু সংরক্ষণ তারা ডিজিটাইজ করেছে। এক বছরে তাদের ৭০ হাজার থেকে ১ লাখ পৃষ্ঠা পর্যন্ত স্ক্যান করার সক্ষমতা আছে।

নিজস্ব সক্ষমতা তৈরির কথা বলে বাংলা একাডেমি তিন দশক ধরেই অবহেলা করে ফেলে রেখেছে পুঁথি সংগ্রহশালাটি। আর তার মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ১ হাজার ৫৩৬টি মূল্যবান সম্পদ; যা পুরোপুরি নষ্ট হলে হারিয়ে যাবে মধ্যযুগের অমূল্য ভান্ডার। প্রাচীন বাংলায় লেখা পুঁথি পড়তে পারেন প্রাবন্ধিক, গবেষক মুহাম্মদ শামসুল হক।

পুঁথি সংরক্ষণ কেন জরুরি, জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘পুঁথি সংরক্ষণ শুধু অতীতের প্রতি মুগ্ধতা না, এ অঞ্চলের মধ্যযুগের ইতিহাস জানার একমাত্র লিখিত রূপ। মধ্যযুগের কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকীর্তি জানা যায় পুঁথি থেকেই। বাংলা একাডেমিতে সংরক্ষণের অভাবে অযত্নে নষ্ট হওয়া পুঁথিগুলো বহু বছর ধরে অনেক পরিশ্রমের সংগ্রহ। এই সম্পদ রাষ্ট্রের। প্রকল্প পাস হোক ভালো কথা। কিন্তু আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পুঁথি সংরক্ষণাগারে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন করা জরুরি।’

বাংলা একাডেমির পুঁথি সংরক্ষণ প্রকল্পে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত প্রকাশনা। এর জন্য সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। প্রকল্পের উদ্বোধন ও সমাপনী অনুষ্ঠানে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ টাকা। অথচ সংগ্রহশালার ছোট কক্ষটিতে একটি শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণযন্ত্র ব্যবহার করলে অন্তত আবহাওয়াজনিত বিপদ থেকে পুঁথিগুলো রক্ষা করা সম্ভব।