দোকানে বিক্রি হচ্ছে উজি পিস্তল

মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উদ্ধার করা উজি পিস্তল। ডিবি কার্যালয়, ২৮ অক্টোবর
ছবি: প্রথম আলো

বৈধ অস্ত্র কেনাবেচার দোকানেই সামরিক বাহিনী ব্যবহার করে, এমন আধা স্বয়ংক্রিয় (সেমি অটোমেটিক) আগ্নেয়াস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। পুলিশ বলেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ব্যক্তি এ ধরনের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র কিনেছেন। লাইসেন্সধারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান কৌশলে এসব অস্ত্র আমদানি করেছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল মোহাম্মদপুর থেকে মদ, বিয়ারসহ মিনাল শরীফ নামের এক ব্যক্তিকে আটক করে। এ সময় তাঁর কাছে ৪৪ রাউন্ড গুলিসহ একটি উজি পিস্তল পাওয়া যায়। সেই পিস্তলের খোঁজ করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পারে, এটি বৈধ অস্ত্র কেনাবেচার দোকান থেকেই কেনা হয়েছিল।

উজি হচ্ছে ওপেন বোল্ট ও ব্লোব্যাক পরিবারভুক্ত একটি অস্ত্র। এর ছোট আকৃতির সংস্করণগুলো ‘মেশিন পিস্তল’ নামে পরিচিত। এটি পিস্তলের মতো হাতের মুঠোয় স্থাপন করে ব্যবহার করা যায়। ইসরায়েলি সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত মেজর উজিয়েল গাল ১৯৪০ সালের দিকে এর নকশা করেন। তাঁর নামানুসারে অস্ত্রটির নামকরণ হয় ‘উজি’। তুলনামূলকভাবে হালকা এবং প্রতি মিনিটে গুলির হার অনেক বেশি হওয়ায় অস্ত্রটি বেশি জনপ্রিয়।

ঢাকা মহানগর পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, তদন্তে নেমে তাঁরা জানতে পারেন, ২০১৫ সাল থেকে ৫ বছরে রাজধানীর লাইসেন্সধারী আগ্নেয়াস্ত্রের ৬টি প্রতিষ্ঠান ১১১টি পয়েন্ট টুটু বোরের উজি পিস্তল ও রাইফেল আমদানি করে। এর মধ্যে ৫৩টি উজি পিস্তল তারা লাইসেন্সধারী ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখনো ৫৮টি তাদের হাতে আছে। যেসব প্রতিষ্ঠান এগুলো আমদানি করেছে, তারা হলো এমএইচ আর্মস কোং, মঈন আর্মস কোং, আহম্মদ হোসেন আর্মস কোং, মেসার্স তোজাম্মেল হোসেন কোং, কে আহমদ আর্মস অ্যান্ড কোং, শফিকুল ইসলাম আর্মস অ্যান্ড কোং।

গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে অস্ত্র বিক্রির প্রতিষ্ঠান এমএইচ আর্মস কোম্পানির মালিক রাজধানীর পুরানা পল্টনের মোকারম হোসেন খানের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়। এতে মোকারম হোসেন লিখিত বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে উত্তরা ব্যাংকের রমনা শাখার মাধ্যমে তিনি এসব অস্ত্র আমদানি করেন। আমদানি করা পণ্য হিসেবে এসব অস্ত্র নিয়মিত শুল্ক পরিশোধ করে ঢাকার কাস্টম হাউস থেকে খালাস করে বিক্রির জন্য গুদামজাত করেন।

এ বিষয়ে মোকারম হোসেন খান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, উদ্ধার করা অস্ত্রটিকে পুলিশ পিস্তল বললেও এটা আসলে রাইফেল। এর গায়ে পিস্তল লেখা আছে। প্রকৃতপক্ষে অস্ত্রটির মডেলের নাম পিস্তল। এটা ইসরায়েলি সাব মেশিনগান। এর ওজন হয় আধা কেজি। আর পয়েন্ট টুটু বোরের উজি রাইফেলের ওজন ২ কেজির মতো। তিনি বলেন, জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়া থেকে এ অস্ত্র আমদানি করা হয়েছে। এর আগে আরও তিন অস্ত্র ব্যবসায়ী এমন অস্ত্র আমদানি করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে, আইনে মেনেই এই অস্ত্র আমদানি ও বিক্রি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

দেশে ৮৪টি লাইসেন্সধারী বৈধ অস্ত্র ব্যবসার প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর এলাকায় ৩২টি অস্ত্রের দোকান আছে। সারা দেশে ১৪ প্রতিষ্ঠান সরাসরি বিদেশ থেকে বৈধ অস্ত্র আমদানি করে, যার মধ্যে ১২টি ঢাকা মহানগর এলাকায়।

ডিবির একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জব্দ করা লাইসেন্স ও অস্ত্রের মধ্যে পার্থক্য ধরা পড়ার পর সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ মতামত চাওয়া হয়। সেখান থেকে বলা হয়, লাইসেন্সে পয়েন্ট টুটু বোরের রাইফেলের কথা উল্লেখ থাকলেও সেমি অটোমেটিক উজি পিস্তল কেনা যাবে না। উজি পিস্তল ও উজি রাইফেল দুটি ভিন্ন আগ্নেয়াস্ত্র। অস্ত্র দুটির যন্ত্রাংশ, ওজন ও দৈর্ঘ্য ছাড়াও বিভিন্ন পার্থক্য রয়েছে। এটি সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত অস্ত্র।

অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার গোলাম মোস্তফা রাসেল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাদকদ্রব্য আইনের মামলায় মিনাল শরীফকে (৫৬) কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার করা উজি পিস্তলটি জব্দ করার পর জিডি করা হয়। ওই জিডির তদন্ত হচ্ছে। অস্ত্র আমদানি করা ছয় প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের জন্য ডিএমপি কমিশনারের কাছে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে পুলিশের কাছে পাঠানো সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ মতামতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহার করা পিস্তলের চেয়েও এটি অত্যাধুনিক সামরিক অস্ত্র। এর ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা ২০ রাউন্ড। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত পিস্তলের সর্বাধিক ম্যাগাজিন ধারণক্ষমতা ১৫ রাউন্ড। এ ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বা ভিআইপিদের নিরাপত্তায় ব্যবহৃত হতে পারে। অস্ত্রের লাইসেন্সে ক্যালিবার ছাড়া অস্ত্রের ধরন সুনির্দিষ্ট থাকা প্রয়োজন। অস্ত্রের লাইসেন্স পিস্তল বা রাইফেল সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও ম্যাগাজিনের ধারণক্ষমতা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সেনা সদর দপ্তরের মতামত পাওয়ার পর বিষয়টি উদ্বেগজনক এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও গভীরভাবে তদন্ত করা হচ্ছে।