দোচালা ঘর

-বাবা বাবা, আমাদের দোচালা ঘরটা কি তাহলে পড়ে যাবে?

বাবা চুপচাপ বসে রইলেন। উত্তর যে তাঁর জানা নেই, সেটা বোঝার বাকি রইল না আমার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা নূর নাহারের দিকে তাকালেন। পাশের রুমে থাকা চৌকিতে বসে আমিও তা শুনতেছিলাম।

- জানি না রে মা। আল্লাহ যেহেতু আমাদের পাঠিয়েছেন তিনিই আমাদের রক্ষা করবেন।

কিন্তু বাতাস বরাবরের মতো এখনো তুমুল বেগে ছুটে চলছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে লকডাউন ছেড়েও মানুষ চলে যাচ্ছে আশ্রয়কেন্দ্রে। বিভিন্ন জেলায় তখন চলেছিল মহাবিপদ সংকেত। বাংলাদেশের আবহাওয়াজনিত সতর্কসংকেতের মাপকাঠিতে এটাই সর্বোচ্চ সংকেত। উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহ ৯ নম্বর বিপৎসংকেতের আওতায় ছিল। এ শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া এটিই ছিল প্রথম সুপার ঘূর্ণিঝড়। ১৯৯৯ ওডিশা ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গোপসাগরে এটি প্রথম সুপার ঘূর্ণিঝড়।

ঢাকায় বাবা হকার হয়ে বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করেন। কিন্তু করোনার কারণে লকডাউন পড়ে যাওয়ায় বাবাকে চলে আসতে হলো গ্রামে। গ্রামের জীবনটা আমাদের খুব দারিদ্র্যের মধ্যেই কেটে যাচ্ছিল। এই মুহূর্তে যদি আমাদের কারোর কোনো কিছু হয়ে যায়, তাহলে করার উপায় কিছুই খুঁজে পাওয়া যাবে না। দারিদ্র্যতায় জর্জরিত যে শুধু আমরাই, আসলে তা না। আশপাশের মানুষগুলোও।

ঝড়ের তীব্র বাতাসে আমাদের দোচালা ঘরটা যে পড়ে যাবে, সে ব্যাপারে আমরা সবাই মোটামুটি ৭০ শতাংশ নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটু সাহস পেয়ে থেকে গেলাম ঘরেই।

মাঝরাতে ঝড় আরও কঠিন আকারে রূপ নিল। বাতাসের তীব্র গতিতে নুয়ে যাচ্ছিল নারকেলগাছ, সুপারিগাছ। চারদিকে শোনা যাচ্ছিল হাহাকার শব্দ। তীব্র ঝড় আর আকাশের তীব্র মেঘের গর্জনে ভয়ে আঁতকে উঠল পুরো পরিবার। নূর নাহার বাবাকে এখনো জড়িয়ে রেখেছে। ঘরের পিলারগুলো আজ থেকে আরও ২৩, ২৪ বছর আগেকার। যার কারণে পিলার থেকেও আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে গিয়েছিল সিমেন্ট। তার পরও মা নতুন করে কিছু সিমেন্ট-বালি দিয়ে সেগুলো মেরামত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি। রীতিমতো সেগুলো আস্তে আস্তে আবারও ঝরে গেছে।

সে রাতের ঝড়ে রান্নাঘরটা পুরোপুরি পড়ে গিয়েছে। থাকার ঘরটাও এক পাশ করে হেলে পড়েছে। তার পরও আল্লাহকে ডাকার কোনো কমতি রাখিনি কেউই। মাঝেমধ্যে বাবাকে বলতে শোনা গেছে,

-শেষ রাতের ঝড়ে এই করোনা চলে যাবে। অসুস্থ পৃথিবী তার রোগ সেরে আবারও সুস্থ হবে। আবারও ঢাকায় যাব। টাকা আয় করে আবারও পাঠাব। এই ঘর ঠিক করব মা, ঠিক করব। আর পেতে হবে না তোর ভয়।

কিন্তু সে কথাগুলো বোনটা আমার শুনতে পেল না। তার আগেই ঘুমিয়ে পড়ল।

*লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ