দোরগোড়ায় বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক

গত ৫০ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। এর মধ্যে অন্যতম কমিউনিটি ক্লিনিক।

কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে প্রতিদিন চার লাখের বেশি মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও পুষ্টিসেবা পায়। প্রয়োজনীয় ২৭ ধরনের ওষুধ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মানুষ বিনা মূল্যে পাচ্ছে। সারা দেশের গ্রামের মানুষের ঘরের দোরগোড়ায় পরম বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্লিনিকগুলো।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে আলোচনা উঠলেই কমিউনিটি ক্লিনিককে বাদ দিয়ে সেই আলোচনা পূর্ণ হয় না। স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্যের পেছনে আছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও উদ্যোগ। জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলেন, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিক। অনেকে দাবি করেন, কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের সাফল্যগাথা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি পুস্তিকার নাম কমিউনিটি ক্লিনিক: হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ

কী সেবা আছে

সরকারি হিসাবে সারা দেশে ১৩ হাজার ৮৮১টি ক্লিনিক চালু অবস্থায় আছে। এসব ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৩০ জন মানুষ সেবা নেয়। আরও ১৪৬টি ক্লিনিক চালুর অপেক্ষায় আছে। ক্লিনিক থেকে: মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা এবং সাধারণ আঘাতে চিকিৎসা দেওয়া হয়। প্রতিটি ক্লিনিকে শিশু ও মায়েদের টিকাদানের ব্যবস্থা আছে। ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। স্বাস্থ্যশিক্ষার পাশাপাশি দেওয়া হয় পুষ্টিশিক্ষা। বয়স্ক, কিশোর–কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে ২৭ ধরনের ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অণুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেওয়া হয়।

কীভাবে চলে

প্রতিটি ক্লিনিকে তিনজন সেবাকর্মী আছেন। মূল দায়িত্বে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)। এই পদের জন্য নারী ও এলাকার মানুষকেই সরকার প্রাধান্য দিয়েছে। সিএইচসিপির সপ্তাহে ছয় দিন ক্লিনিকে থাকার কথা। তাকে সহায়তা করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠকর্মী, যাকে স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে সবাই চেনে। তিনি তিন দিন ক্লিনিকে উপস্থিত থেকে সেবা দেন। এ ছাড়া পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মাঠকর্মী বা পরিবারকল্যাণ সহকারী তিন দিন ক্লিনিকে সেবা দেন। ক্লিনিকে চিকিৎসকের কোনো পদ নেই।

প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক পরিচালনার জন্য সমাজের প্রতিনিধিত্বশীল অংশ নিয়ে ন্যূনতম চারজন নারী সদস্যসহ ১৩ থেকে ১৭ সদস্যের কমিউনিটি গ্রুপ (সিজি) রয়েছে। আবার সিজিকে সহযোগিতা করার জন্য আছে ১৩ থেকে ১৭ সদস্যের কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ। গ্রামের মানুষের জমিতে গড়ে উঠেছে ক্লিনিক।

পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের ভাইস চেয়ার তৌফিক জোয়ারদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিউনিটি ক্লিনিকের অনন্য দিক হচ্ছে কমিউনিটি গ্রুপ ও কমিউনিটি সাপোর্ট গ্রুপ। এলাকার মানুষ স্বাস্থ্যসেবার পরিচালনায় যুক্ত হতে পেরে নিজেদের ক্ষমতায়িত মনে করে। এই দুই গ্রুপের নজরদারির কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকে একধরনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়েছে। মানুষ ক্লিনিকগুলোকে নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে মনে করে।’

ইতিহাস

তবে এই ক্লিনিকগুলো একদিনে এ অবস্থায় আসেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার গঠনের পর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প গ্রহণ করেন।

গ্রামীণ প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে ক্লিনিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। প্রাথমিকভাবে সাড়ে ১৩ হাজার ক্লিনিক নির্মাণের কথা ভাবা হয়েছিল। ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার পাটগাতি ইউনিয়নের গিমাডাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক উদ্বোধন করেন।

স্বাস্থ্য খাতে দলীয় রাজনীতির উদাহরণ হয়ে আছে কমিউনিটি ক্লিনিক। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিকের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল। এর মধ্যে চালু হয়েছিল প্রায় চার হাজার। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপির নেতৃত্বে জোট সরকার ক্ষমতায় এসে ক্লিনিকের কাজ বন্ধ করে দেয়।

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করার উদ্যোগ শুরু হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা এনজিওদের দিয়ে ক্লিনিক চালানোর কথা তখন ভাবা হয়েছিল। ২০০৯ সালে নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম।

কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাপনা ও নীতি নির্ধারণের জন্য সরকার গঠন করেছে কমিউনিটি ক্লিনিক ট্রাস্ট। একে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার প্রকল্প থেকে।

কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে নমুনা কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। প্রতিটি ক্লিনিকসংলগ্ন এলাকার ২৫০ থেকে ৩০০ পরিবারের জন্য একজন করে মাল্টিপারপাস হেলথ ভলান্টিয়ার মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে। সারা দেশে ৭০ হাজার ভলান্টিয়ার দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের আছে। এদের মাধ্যমে ক্লিনিকসংলগ্ন বাড়িগুলোর সদস্যদের স্বাস্থ্যকার্ড দেওয়ারও পরিকল্পনা আছে।

কমিউনিট ক্লিনিক ট্রাস্টের সভাপতি অধ্যাপক সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে একজন মানুষ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে এবং সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে কেউ বঞ্চিত থাকবে না, এটাই ছিল ক্লিনিক গড়ার মূল উদ্দেশ্য। মডেল হিসেবে কমিউনিটি ক্লিনিক বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। তবে উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দেশি–বিদেশি নানা গবেষণায় সফলতা ও সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত হয়েছে। আমরা সীমাবদ্ধতা গুলো ক্রমান্বয়ে দূর করার চেষ্টা চালাচ্ছি।’