ধর্মীয় ও সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের দলে ভেড়ানোর পরিকল্পনা

প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো

মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র, ইসলামি দল ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে থাকা তরুণদের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চায় আনসার আল ইসলাম।

সাম্প্রতিক পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) আল-কায়েদাপন্থী এই জঙ্গি সংগঠনের সদস্য সংগ্রহ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করেছে। তাতে সংগঠনটির এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা গেছে। এতে বলা হয়, কাগজপত্রে কর্মীদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, কেবল বন্দুক আর বারুদের মধ্যে একবিংশ শতাব্দীর ‘যুদ্ধ’ সীমাবদ্ধ নয়। এখন ভাষায় ও জ্ঞানে, কাজে ও কৌশলে দক্ষ হতে হয়। তাই সংগঠনটি মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ‘চৌকস’ ও ‘বিচক্ষণ’ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তারা সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে।

সদস্য হিসেবে আনসার আল ইসলাম কাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্র, ইসলামি দল ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে থাকা তরুণদের দলে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। দলে পুরোপুরি অন্তর্ভুক্তির জন্য এক বছরের প্রশিক্ষণের শর্ত রয়েছে। এর আগে কখনো আনসার আল ইসলাম নারীদের অন্তর্ভুক্তির কথা বলেনি। তবে এবারই প্রথম সংগঠনটি তাদের প্রচারপত্রে পুরুষ ও নারী দুই পক্ষকে উদ্দেশ করে বার্তা দিয়েছে।

গত দুই মাসে সিটিটিসি আনসার আল ইসলামের সাতজন সদস্য ও একজন উগ্রবাদী বক্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সরকারি কলেজের ছাত্র ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক রয়েছেন।

মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখেন, এমন দুজন কর্মী বাকী বিল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম ওরফে জাহেদকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেছিলেন। বাকী বিল্লাহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন, পড়ালেখা শেষ করেননি। তবে প্রযুক্তিজ্ঞানে খুবই দক্ষ।
আহমেদুল ইসলাম, সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার

সিটিটিসির উপকমিশনার আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রতিক অভিযানগুলো থেকে পুলিশ যে তথ্য পাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আনসার আল ইসলাম শক্তিশালী সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিতে মনোযোগী হয়েছে। সমর্থক গোষ্ঠী তৈরিতে তারা মূলত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। তারা বলছে, এই মুহূর্তে তাদের কাজের ৮০ ভাগই মিডিয়া বা প্রচার বিভাগের।

আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, আনসার আল ইসলামের এ-দেশীয় সমন্বয়ক সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক। ২০১৩ সালে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে কুপিয়ে হত্যার মাধ্যমে দলটির আত্মপ্রকাশ। এরপর থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত দলটি মোট নয়টি হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। সবশেষ ২০১৬ সালের এপ্রিলে কলাবাগানে বাসায় ঢুকে ইউএসএআইডির কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বীকে খুন করে দলটির লোকজন। পুলিশ বলছে, জিয়াউল হক বছরে তিন-চারবার তিনি কর্মীদের বার্তা পাঠান। তাঁর সর্বশেষ বার্তাটি গত বছরের ২৯ রমজান পায় সংগঠনটির কর্মীরা।

গত দুই মাসে সিটিটিসি আনসার আল ইসলামের সাতজন সদস্য ও একজন উগ্রবাদী বক্তাকে গ্রেপ্তার করেছে। এঁদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সরকারি কলেজের ছাত্র ও মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক রয়েছেন।

২০১৩ সালে আল-কায়েদা তাদের ভাষায় ‘জিহাদের সাধারণ নির্দেশনা’ প্রকাশ করেছিল। ওই নির্দেশনায় সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন না হওয়ার নির্দেশ ছিল। জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন এমন সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের আনসার আল ইসলাম আল–কায়েদার মতাদর্শ ও নির্দেশনা অনুসরণ করে থাকে। তারা যেসব ইস্যুতে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভ-দুঃখ-হতাশা রয়েছে সেসব বিষয়ে জনমত গঠন, সমর্থক গোষ্ঠী তৈরির পর সেখান থেকে কর্মী বাছাই এবং মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে চায়। দেশের ভেতর আলেমদের সঙ্গেও জোট বাঁধার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান আছে এমন লোকজন তাদের বিশেষ পছন্দের।

সিটিটিসির অতিরিক্ত উপকমিশনার আহমেদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক ব্যক্তিগত যোগাযোগ রাখেন, এমন দুজন কর্মী বাকী বিল্লাহ ও আরিফুল ইসলাম ওরফে জাহেদকে তাঁরা গ্রেপ্তার করেছিলেন। বাকী বিল্লাহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন, পড়ালেখা শেষ করেননি। তবে প্রযুক্তিজ্ঞানে খুবই দক্ষ।

আল কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত নয়টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

বাকী বিল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন, তিনি আনসার আল ইসলামকে টেইল অপারেটিং সিস্টেম চালু করে দিয়েছিলেন। এই সিস্টেম পেনড্রাইভে চলে। পেনড্রাইভ খুলে নিলে যে ডিভাইস থেকে যোগাযোগ বা প্রচার চালানো হয়েছে, সে ডিভাইসে আর কোনো চিহ্ন থাকে না। সবশেষ তাঁরা নজরদারি এড়ানো যায় এমন সফটওয়্যার তৈরির চেষ্টা করছিলেন। এ কাজে অনেক দূর এগিয়েও গিয়েছিলেন। কাজটি চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তিনি ধরা পড়ে যান।

পুলিশ জেনেছে, সৈয়দ জিয়াউল হক তাঁর সদস্যদের বলেছেন, নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সাময়িকভাবে ‘সাথি’ জোগাড় করা তাঁদের উদ্দেশ্য নয়। এতে লম্বা সময় টিকে থাকা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক এ এস এম আলী আশরাফ প্রথম আলোকে বলেন, লেখক অভিজিৎ রায়, প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন হত্যার রায় হয়েছে। ধারাবাহিকভাবে পুলিশ ধরপাকড় করছে। এসব কারণে আনসার আল ইসলাম কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে এবং জঙ্গি হামলার পথ থেকে কিছুটা সরে এসেছে। এখন তারা সদস্য সংগ্রহ, প্রচার, তহবিল সংগ্রহ, নেটওয়ার্ক তৈরির কাজ করবে—এমনটাই হওয়ার কথা।

আল কায়েদাপন্থী জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত নয়টি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল।