ধাপে ধাপে জালিয়াতি, তবু রক্ষা মেলেনি
পণ্য আমদানির নথি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র—সবই জাল। অনলাইনে যাচাইয়ের সময় যাতে জাল ছাড়পত্র ধরা না পড়ে সে জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের আদলে ভুয়া ওয়েবসাইটও খুলেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এত কিছুর পরও শেষ রক্ষা হয়নি। ধরা পড়েছে কাস্টমস কর্মকর্তাদের হাতে।
এই ঘটনায় মুদ্রা পাচার, ফৌজদারি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এই জালিয়াতির ঘটনা ধরা পড়েছে মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা পণ্যের চালান খালাসের সময়। এই চালানটি আমদানি করেছে ঢাকার মৌলভীবাজারের মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ। এটির কর্ণধার মো. আ. জলিল। আমদানিকারকের পক্ষে চালান খালাসে ছিল সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের খান এন্টারপ্রাইজেস।
কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলম আজ রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে খালাসের আগ পর্যন্ত সব ধাপেই জালিয়াতি করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিয়াম এন্টারপ্রাইজ। শুরু থেকে প্রতিটি জালিয়াতির ঘটনা শনাক্তও হয়েছে। এমন অভিনব জালিয়াতির ঘটনায় মুদ্রা পাচার, ফৌজদারি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হবে।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, মালয়েশিয়া থেকে গত এপ্রিলে আনা চালানটির নথিপত্রে ছিল চীনাবাদাম ও জলপাই তেল (অলিভ ওয়েল)। চালানটি পরীক্ষা করে পাওয়া গেছে ২১ টন শিশুখাদ্য। মিথ্যা ঘোষণার অপরাধে আমদানিকারককে মোট ৭৬ লাখ টাকা জরিমানা করেন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। জরিমানা দিয়ে খালাস করতে হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘ক্লিয়ারেন্স পারমিট’ বা ছাড়পত্র নিতে হবে—এমন আদেশও দেওয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি নীতি আদেশ ভঙ্গ করায় এই ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা জুড়ে দেওয়া হয় সেখানে। এখানেও জালিয়াতির আশ্রয় নেয় মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজ। কাস্টমস হাউসে জমা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জাল ছাড়পত্র। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের আদলে তৈরি করে ভুয়া ওয়েবসাইট। জাল ছাড়পত্রে তৈরি করা সেই ভুয়া ওয়েবসাইটের ঠিকানাও লিখে দেয়।
পণ্য আমদানি থেকে শুরু করে খালাসের আগ পর্যন্ত সব ধাপেই জালিয়াতি করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিয়াম এন্টারপ্রাইজ
কর্মকর্তারা জানান, আমদানিকারক জানতেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে শর্তযুক্ত পণ্য আমদানি করেছেন তিনি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এই পণ্য খালাসের ছাড়পত্র পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই একদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নথিপত্র দিয়ে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেন। অন্যদিকে গত ১ অক্টোবর কাস্টমস হাউসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি জাল ছাড়পত্র দিয়ে পণ্য খালাসের চেষ্টা চালান। এরপর ৭ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ওই আমদানিকারক বরাবর মূল ছাড়পত্র দেওয়া হয়। মূল ছাড়পত্রে বলা হয়, আমদানি নীতি আদেশ প্রতিপালন না হওয়ায় এই পণ্য চালানের ছাড়পত্র ইস্যু করার সুযোগ নেই। অনুমতি না পাওয়া পণ্য খালাস করা যাবে না জেনে আমদানিকারক আসল ছাড়পত্রটি কাস্টমস হাউসে জমা দেননি। তখন মূল ছাড়পত্রের তারিখ ও নথি ঠিক রেখে পণ্য খালাস করা যাবে উল্লেখ করে নকল ছাড়পত্র তৈরি করেন তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো কাস্টম হাউসে জমা দেন আমদানিকারক।
পরপর দুটি ছাড়পত্র দেখে সন্দেহ হয় কাস্টমস কর্মকর্তাদের। কাস্টমস-এর সহকারী কমিশনার নূর-এ-হাসনা সানজিদা অনসূয়া তাঁর সন্দেহের বিষয়টি কাস্টমস কমিশনার ফখরুল আলমকে জানান। তিনি দুটো ছাড়পত্রই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে ও সরাসরি কথা বলে যাচাই করার নির্দেশ দেন। কমিশনারের নির্দেশে ছাড়পত্র ইস্যুকারী কর্মকর্তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের সঙ্গে কথা বলে ছাড়পত্র নকল বলে জানতে পারেন। তখনই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যু হওয়া আসল ছাড়পত্র এনে জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হন কাস্টমস কর্মকর্তারা।
যোগাযোগ করা হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই ক্লিয়ারেন্স পারমিটটি ভুয়া। এটি কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
এ ব্যাপারে জানতে মেসার্স সিয়াম এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার আ. জলিলের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। আমদানিকারকের পক্ষে পণ্য খালাসে নিয়োজিত খান এন্টারপ্রাইজেস-এর কর্ণধার গোলাম মওলা খানের মুঠোফোনে পুরো বিষয়টি জানিয়ে খুদে বার্তা পাঠিয়েও উত্তর পাওয়া যায়নি।