ধূপখোলা মাঠে 'বাণিজ্যিক শিশুপার্ক' তৈরির উদ্যোগ!

পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠ। ‘বাণিজ্যিক শিশুপার্ক’ নির্মাণ করা হলে ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকার কমে আসা সবুজ হারিয়ে যেতে পারে l ছবি: প্রথম আলো
পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠ। ‘বাণিজ্যিক শিশুপার্ক’ নির্মাণ করা হলে ঘনবসতিপূর্ণ এ এলাকার কমে আসা সবুজ হারিয়ে যেতে পারে l ছবি: প্রথম আলো

পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ধূপখোলা মাঠে ‘বাণিজ্যিক শিশুপার্ক’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। দীর্ঘদিন ধরে খেলাধুলার অনুপযোগী মাঠটি সংস্কার না করে প্রায় ২০০ কোটি টাকার বিলাসী এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় বাণিজ্যিক পার্কের চেয়ে উন্মুক্ত সবুজ পরিবেশ ও খেলার মাঠ বেশি জরুরি।

ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ জানায়, গত মার্চে ডিএসসিসির অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে ধূপখোলা মাঠে একটি আধুনিক শিশুপার্ক নির্মাণে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে নকশা প্রণয়নের জন্য ‘প্রকল্প উপদেষ্টা’ নামে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নকশার কাজ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। শিগগিরই দরপত্র আহ্বান করা হবে।

প্রায় সাত একর আয়তনের ধূপখোলা মাঠটি বর্তমানে খেলাধুলার অনুপযোগী। মাঠটি তিন ভাগে বিভক্ত। তা হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, ইস্ট এন্ড ক্লাব মাঠ ও স্থানীয় খেলার মাঠ। এই তিনটি মাঠের মালিক ডিএসসিসি। এই মাঠে শিশুপার্ক না করে তা সংস্কার করার দাবি জানিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদ, পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং ক্রীড়া সংগঠকেরা। তাঁরা বলেন, এই মাঠে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণ করা হলে খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত হবে এলাকার শিশু-কিশোর ও যুবকেরা। এ ছাড়া আবাসিক এই এলাকায় সরু সড়কে যানজট বেড়ে যাবে। ডিএসসিসিকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হবে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুপার্ক খেলার মাঠের বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে না। শিশু-কিশোরদের শারীরিক বিকাশের জন্য খেলার মাঠ খুব বেশি জরুরি। এ ছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার জন্য খেলার মাঠ এবং উন্মুক্ত পরিবেশ দরকার। শিশুদের আনন্দ বিনোদনের জন্য অন্যত্র শিশুপার্ক নির্মাণ করা যেতে পারে।

গত শুক্রবার সরেজমিনে দেখা যায়, চারপাশে গাছগাছালিঘেরা ধূপখোলা মাঠের তিনটিতেই পৃথক দলে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলছে প্রায় দুই শতাধিক শিশু-কিশোর। তবে দুটি মাঠ বড় বড় গর্ত ও ইটপাথরে ভরা। বিভিন্ন স্থানে আবর্জনার স্তূপ। স্থানীয় অনেককে ইস্ট এন্ড ক্লাব মাঠের দক্ষিণ পাশে গাছের নিচে আড্ডা দিতে দেখা গেল।

ইস্ট এন্ড ক্লাবের মাঠে বিনা মূল্যে নিয়মিত খুদে ফুটবল খেলোয়াড়দের প্রশিক্ষণ দেয় গেন্ডারিয়া সোনালি অতীত ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সংস্থা। এই সংস্থার সংগঠক ও কোচ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ক্রিকেট ও ফুটবলের জাতীয় পর্যায়ের অনেক খেলোয়াড় এই মাঠে খেলাধুলা করছেন। বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোরেরাও সেখানে নিয়মিত খেলাধুলা করে। এই মাঠে বাণিজ্যিক শিশুপার্ক নির্মাণ করলে পুরান ঢাকার পরিবেশ আরও খারাপ হবে। উন্মুক্ত স্থান বলতে কিছুই থাকবে না।

ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, ওই মাঠে শিশুপার্ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ডিসেম্বরের মধ্যে টেন্ডার-প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে শিশুপার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও ওই প্রকল্প পরিচালক আসাদুজ্জামান বলেন, শিশুপার্কে কী কী রাইড থাকবে, তার নকশা করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তা বাস্তবায়নের পর প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হবে।

পুরান ঢাকার সিদ্দিক বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সদস্য জাবেদ জাহান বলেন, পুরান ঢাকার মধ্যে আয়তনে এই মাঠটি সবচেয়ে বড়। তাঁদের ছোট বেলায় মাঠটি ছিল সবুজে ভরা। কয়েক বছর আগে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নির্মাণসামগ্রী রাখায় মাঠটি নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও শিশু-কিশোরেরা মাঠে খেলাধুলা করে। অনেকে মাঠে সকাল-বিকাল হাঁটতে আসেন। তাই এই ঘিঞ্জি এলাকায় শিশুপার্ক না করে মাঠটি সংস্কার করতে হবে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে শিশুদের জন্য সরকারি-বেসরকারি তেমন কোনো বিনোদন উপযোগী পার্ক নেই। তাই সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার আদলে ধূপখোলা মাঠে আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন একটি শিশুপার্ক তৈরি করা হবে। তিনি বলেন, পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই এই শিশুপার্ক নির্মাণ করা হবে। 

ডিএসসিসির মোট ১৬টি খেলার মাঠ ছিল। এর মধ্যে বর্তমানে ৭টিই বেদখলে রয়েছে। আর দখলে থাকা মাঠগুলোর অধিকাংশই খেলাধুলার অনুপযোগী।