নকশিকাঁথার গ্রাম

নকশিকাঁথা তৈরি করছেন এক নারী। গত সপ্তাহে জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর গ্রামে।ছবি: প্রথম আলো

মৈমনসিংহ গীতিকায় কবি চন্দ্রাবতীর রামায়ণকাব্যে সীতার গুণের কথা বলতে গিয়ে নকশিকাঁথার প্রসঙ্গটিও উঠে আসে। সেখানে বলা হয়,
‘সীতার গুণের কথা কী কহিব আর,
কন্থায় আঁকিল কন্যা চান, সুরুয, পাহাড়’
সেই আদিকাল থেকে নকশিকাঁথা বাঙালির ঐতিহ্য আর আভিজাত্যের অন্যতম উপকরণ হয়ে আছে। গ্রামীণ জনপদ ছাড়িয়ে নকশিকাঁথার কদর এখন বিদেশেও। জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর, দক্ষিণ বাঁশতা (বস্তা), বানাইচ, কানাইপুকুর, বানিয়াচাপড়, শিবপুরসহ আশপাশের ১০ গ্রামের শতাধিক নারীর হাতে তৈরি হচ্ছে বাহারি সব নকশিকাঁথা। ওই সব গ্রামের অনেক নারী নকশিকাঁথা তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন। তাঁদের তৈরি নকশিকাঁথা বিদেশেও যাচ্ছে।

‘স্বদেশপ্রীতি’ নামে নারীদের একটি সংগঠন এই নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ ও নকশিকাঁথা বিপণনের ব্যবস্থা করছে। সংগঠনটির উদ্যোক্তা আলমপুর গ্রামের গৃহবধূ জোবেদা আক্তার। তিনি আলমপুর জাগরণী মহিলা সমবায় সমিতির সভাপতি। ক্ষেতলাল উপজেলার আলমপুর গ্রামেই বাবার বাড়ি জোবেদা আক্তারের। অল্প বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। স্বামী শাহ সুলতান মাহমুদ বগুড়ার একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করেন।

জোবেদা আক্তার বলেন, ২০০১ সালের দিকে আলমপুর গ্রামের ৩০-৩৫ জন নারীকে নিয়ে নকশিকাঁথা সেলাইয়ের কার্যক্রম শুরু করেন। গঠন করা হয় আলমপুর জাগরণী মহিলা সমবায় সমিতি। পরে সমিতি থেকে নারীদের হস্তশিল্প, ব্লক–বাটিকসহ সেলাই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। নারীদের তৈরি করা ‘নকশিকাঁথা’ গ্রাম ঘুরে সংগ্রহ করে তা পাইকারি ক্রেতাদের কাছে বিক্রি শুরু হয়। প্রথমে এসব পণ্য কৃষিমেলা, হস্তশিল্প মেলাসহ বিভিন্ন মেলার স্টলে বিক্রি করা হতো। ধীরে ধীরে নকশিকাঁথা তৈরির কর্মযজ্ঞ আলমপুর থেকে আশপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এখন প্রতি মাসে গড়ে ৭০-৮০টি কাঁথা তৈরি হয়। বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঢাকার বিভিন্ন শোরুম মালিক ছাড়াও বিদেশে হস্তপণ্য রপ্তানিকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজন এসব ‘নকশিকাঁথা’ সংগ্রহ করে। একটি কাঁথা তৈরিতে এক মাস থেকে চার মাস পর্যন্ত সময় লাগে। একটি নকশিকাঁথা বিক্রি করে নারীদের ৪ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত লাভ হয়।

আলমপুর গ্রামের ঘরে ঘরে নারীরা সুই-সুতা হাতে নকশিকাঁথা সেলাইয়ে ব্যস্ত। বানাইচ গ্রামের নাদিয়া আকতার ছয়টি কাঁথা নিয়ে জোবেদা আক্তারের মাধ্যমে বিক্রি করতে এসেছিলেন। তিনি বলেন, তিন মাসে ৬টি নকশিকাঁথা সেলাই করেছেন। এর মধ্যে গোলাপের ফুলতোলা একটি ‘গোলাপকাঁথা’। এতে খরচ পড়েছে ৪ হাজার টাকার মতো। অন্যগুলো ‘গুজরাটি কাঁথা’, ‘পার্টি কাঁথা’ ও ‘বিস্কুটকাঁথা’। এসব কাঁথায় খরচ পড়েছে ২ হাজার টাকার মতো। পাইকারি পর্যায়ে একেকটি ‘গোলাপকাঁথা’ কাজভেদে বিক্রি হয় ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। অন্যগুলো বিক্রি হয় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা।

নকশিকাঁথা সেলাইয়ে রকমফের রয়েছে। রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, বোতামঘর, চেইন ফোঁড়, পখুরি, তারা ফোঁড় ইত্যাদি ফোঁড় বা সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনা হয়।

নারী কারিগরেরা জানান, নকশিকাঁথার নকশার ওপর নানা নাম দেওয়া হয়। আছে গোলাপকাঁথা, ময়ূরের পাখাকাঁথা, বলকাঁথা, গুজরাটি কাঁথা, প্রিন্ট কাঁথা, পুঁটি মাছের ঝাঁক কাঁথা, মৌমাছির চাক কাঁথা, সুজনী কাঁথা, পাটি কাঁথাসহ অনেক নাম।

নারীরা জানান, নকশিকাঁথা সেলাইয়ে রকমফের রয়েছে। রান ফোঁড়, ডবল রান ফোঁড়, ডারনিং ফোঁড়, বেঁকি ফোঁড়, বখেয়া ফোঁড়, বোতামঘর, চেইন ফোঁড়, পখুরি, তারা ফোঁড় ইত্যাদি ফোঁড় বা সেলাইয়ে নকশিকাঁথা বোনা হয়। নকশিকাঁথা সেলাইয়ে এসব ফোঁড়ই মূল।

নকশিকাঁথার কারিগর নাহিদা আকতার বলেন, হাট-বাজারের তাঁতিদের কাছ থেকে রঙিন কাপড় এবং লাল, নীল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ প্রভৃতি রঙিন সুতা কিনে এনে নকশিকাঁথা সেলাই করেন তাঁরা। কয়েকজন একসঙ্গে বসে গল্পে গল্পে নকশিকাঁথার কাজ করেন। অনুপম দক্ষতায় কাঁথার জমিনে ফুটে ওঠে নানা কারুকাজ। কোনো সময় কাঁথায় উঠে আসে দুঃখ-সুখের কাহিনি।