নগরে ক্ষুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তিতে নগর আদালত আইনের প্রস্তাব

গ্রাম আদালতের মাধ্যমে ইউনিয়ন পর্যায়ে বিচার হচ্ছে। এ ধরনের আদালত নগরে করার দাবি উঠেছে

দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনে কয়েক কোটি মানুষের বসবাস। ক্ষুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির জন্যও এই মানুষগুলোকে আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। আদালতে বিচারকের স্বল্পতাসহ নানা সীমাবদ্ধতায় মামলাজট লেগেই আছে। তাই নগরের বাসিন্দাদের জন্য নগর আদালত আইনের একটি খসড়া প্রস্তাব করা হয়েছে। এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ, মাদারীপুর লিগ্যাল এইড অ্যাসোসিয়েশন (এমএলএএ), বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও নাগরিক উদ্যোগ সম্মিলিতভাবে এটা তৈরি করেছে।

আজ সোমবার ‘নগর আদালত আইন: প্রস্তাবিত রূপরেখা এবং বাস্তবায়নের সম্ভাবনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে ওই প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। তবে নগর আদালত করার পাশাপাশি সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করলে তা নতুন নতুন সমস্যার জন্ম দেবে বলে অভিমত দেন আলোচকেরা।

সংলাপের প্রধান অতিথি স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, নানা বিতর্ক ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে জনগণ বিরোধ মীমাংসার জন্য গ্রাম আদালতের সুবিধা পাচ্ছে। নগরেও এ ধরনের একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি। তবে এ আদালতের ক্ষেত্রে সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আর স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনা সম্ভব না হলে মানুষ আদালতের সুফল ভোগ করতে পারবে না। দুর্ভোগ বাড়বে।

আদালতে আবেদন করা থেকে শুরু করে প্রতিটি পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর সুপারিশ করেন মন্ত্রী। এ বিষয়ে সফটওয়্যার তৈরিরও পরামর্শ দেন তিনি।
তাজুল ইসলাম জানান, গ্রাম আদালতকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য বিভিন্ন অনিয়মের জন্য যেমন শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, একইভাবে ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আইনটি সংশোধনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা ও জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে বলেই ডেঙ্গু, জলাবদ্ধতাসহ বিভিন্ন সমস্যা ‘নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে’।

সংলাপ সঞ্চালনার পাশাপাশি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সুবিচার পাওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এটা থেকে বঞ্চিত হলে অন্যান্য বঞ্চনাও শুরু হয়। নগর আদালতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেবে।
নগর আদালত গঠিত হলে আদালতের সীমানা নির্ধারণ, সুরক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় রাখার পাশাপাশি এ আদালতের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনের সম্পৃক্ততা জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সংলাপে ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ সালে দেশের বিভিন্ন আদালতে বিচারের জন্য অপেক্ষমাণ মামলা ছিল ৯ লাখ। গত বছর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ লাখের বেশি। এ পরিস্থিতিতে নগর আদালতের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ‘জমিজমার সমস্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মানুষ আমার কাছে আসেন। কিন্তু আইনি বাধ্যবাধকতায় সমাধান দিতে পারি না। গ্রামে চেয়ারম্যান সমস্যার সমাধান করতে পারেন।’

মেয়র আতিকুল ইসলাম নগর আদালত করা হলে সেখানে সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলরকে সভাপতি করার সুপারিশ করেন। আদালতের খরচ কোথা থেকে আসবে এবং মিথ্যা মামলা করলে তার যে জরিমানা আদায় করা হবে, তা কোন অ্যাকাউন্টে থাকবে, তা-ও স্পষ্ট করতে হবে বলে মত দেন তিনি।

সুশাসনের ঘাটতি নিয়ে আলোচকদের উদ্বেগ প্রসঙ্গে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে খারাপ কাজ করে কেউ পার পাচ্ছেন না। একইভাবে অন্যায় বিচার করেও কেউ পার পাবেন না। আর আইনে আপিলের সুযোগ তো থাকছেই। আদালতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানও নগর আদালতের সফলতার জন্য আইনের শাসন ও সুশাসন নিশ্চিত করার বিষয়টিতে গুরুত্ব দেন।

সংলাপে আইনের প্রস্তাবটি নিয়ে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন এমএলএএর প্রধান সমন্বয়কারী খান মো. শহীদ। তিনি জানান, পৌরসভা পর্যায়ে রয়েছে বিরোধ মীমাংসা (পৌর এলাকা) বোর্ড আইন ২০০৪। অথচ নগরের জন্য এ ধরনের কিছু নেই। এমএলএএর সম্পাদক ফজলুল হক এবং নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন সংলাপে স্বাগত বক্তব্য দেন।

আলোচনায় সেন্টার ফর পিচ অ্যান্ড জাস্টিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ফস্টিনা পেরেইরা বলেন, নগরের সুনির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানে আলাদা একটি আইন প্রণয়ন করা জরুরি। নগর আদালত আইন প্রণয়নের আগে প্রতিবেশী দেশসহ অন্যান্য দেশে এ ধরনের আদালত কীভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে, সেগুলোও দেখা প্রয়োজন। নগর আদালতে যাঁরা ন্যায্যতা স্থাপনে অংশ নেবেন, তাঁদের মানবাধিকারের মতো বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে।

ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন বলেন, নগর আদালত হলে সেখানে বিরোধ নিষ্পত্তির নামে যাতে নতুন ধরনের অন্যায়ের সূচনা না হয়, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। নগর আদালতে আলাদা করে কোনো আইনজীবী না থাকলে তা নতুন ধরনের জটিলতা তৈরি করবে কি না, ভেবে দেখতে হবে। আদালতের কার্যক্রমে স্থানীয় পর্যায়ে আইনি সহায়তা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা, আদালতের প্যানেলে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ, শাস্তির চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যাতে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারে, সেসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়ারও সুপারিশ করেন তিনি।