নগরে থাকেন, তাই ভাতা নেই

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে থাকেন ঝরনা বেগম। স্বামী আবদুর রহিম রোগে ভুগে বছর বিশেক আগে মারা গেছেন। পাঁচ ছেলের মা ঝরনা বেগম জানালেন, তিন ছেলে বিয়ে করে যার যার মতো থাকেন। দুই ছেলের ‘মাথায় অসুখ’। তাঁকেই দেখতে হয় দুজনকে। সংসার চালাতে এই বয়সে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তিন বাসায় কাজ করেন তিনি। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বিধবা হিসেবে ভাতা পাওয়ার উপযুক্ত হলেও মহানগর এলাকায় থাকার কারণে এ সুবিধা থেকে তিনি বঞ্চিত।

ঝরনা বেগম তাঁর বয়স ৬৭–৬৮ দাবি করলেও জাতীয় পরিচয়পত্র অনুসারে বয়স ৫৯ বছর। সরকারের বয়স্ক ভাতা পেতে হলে তাঁকে কমপক্ষে ৬২ বছর বয়সী হতে হবে।

দুটি ভাতার কোনোটাই না পাওয়ায় ক্ষোভের শেষ নেই ঝরনা বেগমের! কড়াইল বস্তিতে ঝরনা বেগমের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল তাঁর সঙ্গে। জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি হাতে নিয়ে ক্ষোভের সঙ্গে প্রত্যাশিত মন্তব্যটি করলেন, ‘সবাই এসে খালি নাম লিখে নিয়ে যায়। কই কোনো ভাতাই তো পাই না। বয়স্ক না দাও, বিধবা তো দাও।’

সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে ভাতাগুলোর মধ্যে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয়।
মো. সাব্বির ইমাম, সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক

সমাজসেবা অধিদপ্তর ও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা গেছে, ২৩টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে সরকারের ১৪৩টি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি রয়েছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা, বয়স্ক ভাতাসহ দারিদ্র্য দূরীকরণ, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের বেশ কিছু সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে সমাজসেবা অধিদপ্তর। অধিদপ্তর সরাসরি ভাতা দেওয়ার ১৩টি কর্মসূচি পরিচালনা করে। এর মধ্যে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ শিরোনামের ভাতা কর্মসূচিটি মহানগর এলাকায় বাস্তবায়ন হয় না।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের সামাজিক নিরাপত্তা শাখার পরিচালক মো. সাব্বির ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের সব জেলা-উপজেলায় ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। তবে ভাতাগুলোর মধ্যে ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলা ভাতা’ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার জন্য প্রযোজ্য নয়।’

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৮’ অনুসারে দেশে বিধবার সংখ্যা ৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং তালাকপ্রাপ্ত বা বিচ্ছিন্ন নারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ৬৬ শতাংশের বেশি বিধবা। মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান।

সরাসরি ভাতা কর্মসূচি: ১৩টি। মহানগর এলাকা বাস্তবায়ন হয়: ৩টি। ভাতা পান: ৯১ লাখ ৬৩ হাজার। সূত্র: সমাজসেবা অধিদপ্তর

মহানগর এলাকার বস্তিবাসী হওয়ায় আফিয়া খাতুনও বঞ্চিত ভাতা পাওয়া থেকে। কড়াইল বস্তির আফিয়া খাতুনের (৪৫) স্বামী আয়নুল মিয়া ১২ বছর আগে দুই মেয়েসন্তানের দায়িত্ব স্ত্রীর ওপর রেখে চলে যান। আর কখনো খোঁজ করেননি। আফিয়া বললেন, ‘বহু কষ্টে খাইয়া না–খাইয়া দিন কাটাইছি। এখন মেয়েরা গার্মেন্টসে চাকরি করে। সেই টাকায় চলি।’

বেসরকারি সংগঠন কড়াইল কমিউনিটি বেইজড অর্গানাইজেশনের সভাপতি মোসাম্মৎ সেলিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, বস্তিতে শুধু বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী, এ দুটি ভাতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়। প্রতিবন্ধীদের ৮০ শতাংশ ভাতা পেলেও বয়স্কদের মধ্যে খুব সামান্য মাত্র ২০ শতাংশ ভাতা পান।

বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ভাতা শাখাটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক-২ এম এম মাহমুদুল্লাহর অধীনে পরিচালিত হয়। মহানগর এলাকায় এই ভাতাটি চালু না থাকা প্রসঙ্গে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মহানগর এলাকায় ভাসমান লোকের সংখ্যা বেশি এবং কাজের ক্ষেত্র তুলনামূলক বেশি থাকায় সরকার ভাতাটি এখানে কার্যকর রাখেনি। তিনি জানান, সরাসরি ভাতা দেওয়ার ১৩টি কর্মসূচির বাইরে ক্ষুদ্রঋণ, প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনের মতো ৫২টি কর্মসূচি অধিদপ্তরের অধীনে বাস্তবায়িত হয়।

নগরে বয়স্ক ভাতার বাইরে ৯৮ শতাংশ
গত বছরের জুলাই মাসে বিবিএস প্রকাশিত নগর আর্থসামাজিক আস্থা নিরূপণ জরিপে বলা হয়েছে, নগরাঞ্চল বাস্তবায়নাধীন বৃহৎ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় থাকলেও এ থেকে সুবিধাপ্রাপ্তির সংখ্যা ন্যূনতম। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলোর ক্ষেত্রে নগরাঞ্চলের নিম্ন আয়ের খানাগুলো ব্যাপকভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে। বয়স্ক ভাতার আওতায় আছে মাত্র ২ শতাংশ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি পায়, এমন খানা পাওয়া গেছে মাত্র ৩ শতাংশ। কর্মসূচিগুলো নিম্ন আয়ের খানাগুলোর প্রয়োজনের সঙ্গেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ২০১৯ সালের ৮ থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি পরিচালনা করা হয়। জরিপে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগর এবং বাকি মহানগরগুলোর দুটি এলাকা ধরে মোট ৮৬টি এলাকা থেকে ২ হাজার ১৫০টি নগরাঞ্চলের খানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ পরিচালক কে এ এম মোর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রামকেন্দ্রিক। সরকারি আলোচনায় দরিদ্র নিয়ে কথা উঠলেই তাঁরা গ্রাম নিয়ে ভাবেন। নগরে দরিদ্র বাড়ছে। এক দশক ধরে বিভিন্ন আলোচনায় শহরের দরিদ্রদের নিয়ে আলাদাভাবে ভাবার তাগিদ দেওয়া হচ্ছে সরকারকে। তিনি বলেন, শহর অঞ্চলের ঝুঁকি গ্রামের চেয়ে আলাদা। শহরে ভাসমান মানুষও বেশি। নগরের দরিদ্রদের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে প্রাধান্য দিয়ে ভিন্ন নকশায় ভাতার ব্যবস্থা করা উচিত।
বস্তিশুমারি ২০১৪ অনুসারে, ১৯৯৭ সাল থেকে ২০১৪ সালে শহরাঞ্চলে বস্তির সংখ্যা ২ হাজার ৯৯১টি থেকে বেড়ে ১৩ হাজার ৯৯৫টি হয়েছে। জনসংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজারের বেশি। নারীর সংখ্যা ১০ লাখ ৩২ হাজারের বেশি। তৃতীয় লিঙ্গ ১ হাজার ৮৫২ জন। বস্তিবাসীদের প্রায় ৫ শতাংশ বিধবা। শুমারি অনুসারে ভাসমান মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১৬ হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় ৩৬ শতাংশ বিধবা এবং ১ শতাংশের বেশি নারী তালাকপ্রাপ্ত বা বিচ্ছিন্ন।

শহরে মানুষের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়লেও ভাতা বরাদ্দ হয় ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুসারে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০১৮’ অনুসারে দেশে বিধবার সংখ্যা ৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং তালাকপ্রাপ্ত বা বিচ্ছিন্ন নারীর সংখ্যা ১ দশমিক ৪ শতাংশ। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের ৬৬ শতাংশের বেশি বিধবা। মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৪৬ লাখ। নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এম এম মাহমুদুল্লাহ বলেন, ‘এলাকার জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাতার অর্থ বরাদ্দ করি আমরা। এলাকার জনসংখ্যার হিসাব করা হয় ২০১১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী ২০১৯ সালে তাঁর ভাতাভোগীদের ওপর কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, টাকা কম হলেও ভাতার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। ভাতাভোগীরা এই টাকা দিয়ে ওষুধসহ প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা করতে পারেন বলে পরিবারে তাঁদের ক্ষমতায়ন হয়। তিনি ভাতার অর্থ ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর ওপরও জোর দেন।