নতুন আইনি দল করল মিয়ানমারের জান্তা

মিয়ানমারের আট সদস্যের ওই আইনি প্রতিনিধিদলে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে চারজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন

রোহিঙ্গারা গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে।
ছবি: প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার আইনি প্রতিনিধিদলে পরিবর্তন এনেছে মিয়ানমার। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির পরিবর্তে ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেবেন দেশটির সামরিক সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উনা মং লুইন।

মিয়ানমার গেজেটের বরাত দিয়ে দেশটির অনলাইন সংবাদমাধ্যম ইরাবতী গত বৃহস্পতিবার রাতে এ খবর জানিয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাসের মাথায় এসে মিয়ানমারের সামরিক সরকার এই পরিবর্তন আনল। গত ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখলের পর সু চিসহ শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিকদের বন্দী করে সেনাবাহিনী।

মিয়ানমারের আট সদস্যের ওই আইনি প্রতিনিধিদলে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে চারজন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এঁরা হলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী উনা মং লুইন ও অর্থমন্ত্রী উইন শেইন এবং দুই লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়ার পায়ে ও মিউ জ থেইন। অন্যরা হলেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কো কো লায়েং, অ্যাটর্নি জেনারেল থিডা ও, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী চ মিউ টুট ও খিন ও’ লায়েং।

গত সপ্তাহে মিয়ানমারের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব এবং আগামী মাসে আইসিজেতে গণহত্যার মামলায় নিজেদের অবস্থান তুলে ধরার আগে জান্তা সরকারের এ সিদ্ধান্ত এল। সাধারণ পরিষদের ওই প্রস্তাবে দেশটির সেনাবাহিনীর কাছে অস্ত্র বিক্রি নিষিদ্ধ ও সেখানে সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।

এদিকে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী নির্বাসিত জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজি) আইসিজের মামলায় দেশের প্রতিনিধিত্ব করার ঘোষণা দিয়েছিল। এ ছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হচ্ছে। এসব বিষয়ও মিয়ানমারের সেনাশাসকের এমন সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছ বলে মনে করেন কেউ কেউ।

তবে ঢাকা ও নিউইয়র্কের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, সাধারণত প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে আগস্টে জাতিসংঘে ক্রেডেনশিয়াল কমিটির বৈঠক বসে। সেখানে প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিদের জাতিসংঘে নিজের দেশকে উপস্থাপনের বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এরই মধ্যে জাতিসংঘে মিয়ানমারের স্থায়ী প্রতিনিধি চ মোয়ে টুন সামরিক সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে নির্বাসিত সরকারের পক্ষে আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। এ পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের নতুন ঘোষিত আইনি প্রতিনিধিদলটির ভবিষ্যৎ কী হবে সেটার দেখার জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষায় থাকতে হবে।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার কারণে সাত লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের নভেম্বরে আইসিজেতে মামলা করে গাম্বিয়া। ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) পক্ষে আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া মামলাটি করে। ওই বছরের ডিসেম্বরে আইসিজেতে গণহত্যা মামলার অন্তর্বর্তী আদেশের বিষয়ে শুনানি হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের জানুয়ারিতে মামলার দুই পক্ষ গাম্বিয়া ও মিয়ানমার—দুই দেশকে তাদের প্রতিবেদন ও প্রতিবেদনের জবাবের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।

রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা নিশ্চিতের পাশাপাশি গণহত্যার আলামত নষ্ট না করাসহ অন্তর্বর্তী আদেশে আইসিজে ছয়টি বিষয়ে সুষ্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেন। আইসিজের অন্তর্বর্তী আদেশে মিয়ানমার কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা পরবর্তী চার মাসে আদালতকে জানানোর কথা ছিল। পরে প্রতি ছয় মাস পরপর আদালতকে মিয়ানমার ওই ছয় অন্তর্বর্তী আদেশের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নিয়েছে সে সম্পর্কে হালনাগাদ তথ্য দেবে বলে ঠিক হয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগপর্যন্ত আইসিজেতে দুই দফা প্রতিবেদন জমা দিয়েছিল মিয়ানমার।

আইসিজেতে গণহত্যা মামলায় মিয়ানমারের আইনজীবী দলে পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের জ্যেষ্ঠ ফেলো শহীদুল হক গতকাল বলেন, মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সিদ্ধান্তটি লক্ষ করার মতো। কারণ, এ বছরের জানুয়ারিতে মিয়ানমার আদালতের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল। ফলে সামরিক সরকার এই মামলা নিয়ে কী পদক্ষেপ নেয়, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। এরই মধ্যে আবার মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকার এই মামলার বিষয়ে নিজেদের অবস্থান এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের মতামতের কথা জানিয়েছে। এখন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের আগে সামরিক সরকারের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেয়, সেটা দেখার বিষয়।