নতুন পতঙ্গভুক উদ্ভিদ জলজঝাঝি

নৌকায় তোলার পরে জলজঝাঝি। কোটচাঁদপুরের জয়দীয়া বাঁওড়ে গত বছর তোলা।
ছবি: সংগৃহীত

উদ্ভিদটির কোনো শিকড় নেই, পানিতে ভাসে। অনেক সময় কিছুটা ডুবন্ত অবস্থায় থাকে এরা। আশপাশে কোনো কীটপতঙ্গ এলে এরা পাতাগুলো ভাসিয়ে দেয়। সেখান থেকে একধরনের মিষ্টি রস ছাড়ে। আর সুগন্ধের টানে ও মিষ্টি খাবার খেতে ওই কীটপতঙ্গ সেখানে বসে পড়ে। উদ্ভিদটি এবার আরও মিষ্টি রস ছেড়ে প্রাণীটিকে ওই পাতার মধ্যে আটকে ফেলে। তারপর ধীরে ধীরে পাতাটির চারপাশে থাকা আবরণটি দিয়ে ঢেলে ফেলে। পতঙ্গটি উদ্ভিদের বন্ধ প্রকোষ্ঠে আটকে মারা যায়। এরপরে উদ্ভিদটি ওই মৃত শরীর থেকে প্রোটিন সংগ্রহ করে বা সোজা কথায় খেয়ে ফেলে।

এটা কোনো কল্পকাহিনি নয়। বাংলাদেশের ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার জয়দীয়া বাঁওড়ে ওই উদ্ভিদটি খুঁজে পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। ভৈরব নদের গতিপথ বদলে যাওয়ায় মৃত নদের অংশটিই এখন জয়দিয়া বাঁওড়।

দেশের উদ্ভিদ শ্রেণিবিন্যাস তত্ত্ব গবেষণার অন্যতম পুরোধা আবুল হাসানের নেতৃত্বে অধ্যাপক আল মুজাদ্দিদী আলফাসানি এবং রউফ আহমেদ ভূঁইয়া ওই গবেষণা করেছেন। উদ্ভিদটির নাম রাখা হয়েছে জলজঝাঝি। উদ্ভিদটির বৈজ্ঞানিক নাম রাখা হয়েছে Utricularia rosettifolia alfasane & hassan। গবেষক দলের প্রধান দুই সদস্যের নামের অংশ ওই উদ্ভিদটির নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অধ্যাপক আল মুজাদ্দিদী আলফাসানি প্রথম আলোকে বলেন, এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই নতুন উদ্ভিদ না। বিশ্বে এই উদ্ভিদটি প্রথমবারের মতো দেখা গেল। ফলে এটি যে বাঁওড়ে দেখা গেছে তার প্রতিবেশব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করা উচিত। আর দেশের একই প্রতিবেশব্যবস্থা আছে এমন জলাশয়গুলোতে জরিপ চালানো উচিত।

এর আগে বিশ্বে এ ধরনের ২২০টি প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা গিয়েছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশেই দেখা গিয়েছিল মোট আট প্রজাতির। কিন্তু আগেরগুলোর তুলনায় এ জয়দিয়া বাঁওড়ে দেখা পাওয়া ওই প্রজাতিটির নতুনত্ব কী? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে ওই গবেষক দলের পক্ষ থেকে প্রকাশ করা এক গবেষণা প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়, নতুন এই উদ্ভিদটির কোনো শিকড় নেই। এটি মূলত পতঙ্গকে ফাঁদে ফেলে খায়। সূর্যের আলো, পানি থেকে সংগ্রহ করা কিছু খাদ্য উপাদান ও পতঙ্গ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে এরা বেঁচে থাকে।

গত ডিসেম্বর মাসে প্ল্যান্ট টেক্সন নামের বাংলাদেশভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞান সাময়িকী পিয়ার রিভিউড জার্নাল–এ তা প্রকাশিত হয়েছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গবেষক দলটি ওই উদ্ভিদটির নমুনা সংগ্রহ করে। তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের একটি কংক্রিটের কুয়াতে এনে রাখা হয়। পরে তা বিভাগের নিজস্ব বিজ্ঞান পরীক্ষাগারে নিয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়।

জয়দীয়া বাঁওড়ে জলজঝাঝি। গতবছর তোলা।
ছবি: সংগৃহীত

এ গবেষণার ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক জসিমউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের জন্য নতুন এ উদ্ভিদটি পাওয়া যাওয়া বিজ্ঞানের জগতে একটি নতুন ঘটনা। আমাদের প্রতিবেশব্যবস্থায় এ ধরনের আরও অনেক উদ্ভিদ–প্রাণী আছে কি না, তা অনুসন্ধান করে দেখা উচিত। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক উদ্ভিদ হয়তো পাওয়া সম্ভব হবে।

গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, জয়দিয়া বাঁওড়টির আয়তন ২ দশমিক ১৬ বর্গকিলোমিটার আর গভীরতা সোয়া ৩ মিটার। জয়দিয়া বাঁওড়ের পানি শীতকালে শুকিয়ে যায়। তখন সেখানে ধান ও অন্যান্য ফসলের চাষ হয়। তখন ওই ভাসমান উদ্ভিদটির পাতা মাটির সঙ্গে মিশে যায়। বর্ষাকালে বাঁওড়ে পানি এলে সেটি আবারও প্রাণ ফিরে পায়। উদ্ভিদটি শুকনো পাতা থেকে আবারও জন্মায়। তবে অনুকূল প্রতিবেশ ব্যবস্থা না পেলে, তা জন্মাবে না। অনুকূল প্রতিবেশব্যবস্থা পেলে তিন বছর পরও শুকনো পাতা থেকে তা জন্মাতে পারে বলে গবেষণাটিতে বেরিয়ে এসেছে।

উদ্ভিদটি জীবন্ত অবস্থায় সবুজ রঙের হয়, আকৃতি হয় লম্বাটে। ১ দশমিক ৮ মিটার থেকে আড়াই মিটার দৈর্ঘ্য আর ১ দশমিক ৮ মিলিমিটার প্রস্তের হয় এটি। জুলাই থেকে অক্টোবরের মধ্যে এতে হলুদ রঙের ফুল ফোটে।

গবেষক দলটি সূত্রে জানা গেছে, আরও বিস্তারিত গবেষণার জন্য উদ্ভিদটির একটি নমুনা সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় হারবেরিয়ামে রাখা হয়েছে। এই উদ্ভিদটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছাড়াও অন্য কোনো গুরুত্ব আছে কি না বা কোনো ঔষধি গুণ আছে কি না তা নিয়ে এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে গবেষক দলটি।

নৌকায় তোলার পরে জলজঝাঝি। কোটচাঁদপুরের জয়দীয়া বাঁওড়ে গত বছর তোলা।
ছবি: সংগৃহীত

জাতীয় হারবেরিয়াম সূত্রে জানা গেছে, দেশের ৩ হাজার ৮৩৫ প্রজাতির উদ্ভিদের সঙ্গে আরও একটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্ভিদের জাত সংরক্ষণ কেন্দ্র যুক্তরাজ্যের কিউ র‌্যায়াল বোটানিক্যাল গার্ডেনের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বে মোট ৩ লাখ ৯১ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যার মধ্যে ৩ লাখ ৬৯ প্রজাতির ফুল ফোটে। প্রতিবছর দুই হাজার নতুন প্রজাতির উদ্ভিদ আবিষ্কৃত হয়, যার বেশির ভাগই বিলুপ্তির পথে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় হারবেরিয়ামের পরিচালক পরিমল সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বের উদ্ভিদের তালিকায় নতুন একটি প্রজাতি যুক্ত হলো, এটা আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। নতুন পাওয়া এই ফুলের গাছটির কোনো ঔষধিগুণ আছে কি না, তা আমরা আরও গবেষণা ও অনুসন্ধান করে দেখব।’