নববর্ষ, মুজিব বর্ষ, আমাদের করণীয়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নববর্ষে’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘নিশি অবসানপ্রায়, ওই পুরাতন/ বর্ষ হয় গত!/ আমি আজি ধূলিতলে এ জীর্ণ জীবন/ করিলাম নত।/ বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,/ ক্ষমা করো আজিকার মতো/ পুরাতন বরষের সাথে/ পুরাতন অপরাধ যত।’ এই কবিতা অবশ্য পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে লেখা। তবে ২০১৯-এর অবসানে ২০২০-এর সকালবেলায় এই কবিতা উচ্চারণ করলে লাভ ছাড়া ক্ষতি তো দেখি না।

এই কবিতা আমাদের কাছে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এ জন্য যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের রোজনামচায় কবিতাটির বিশেষ রকমের উল্লেখ আছে। ১৩৭৪ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে জেলবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে সহবন্দী মিজানুর রহমান চৌধুরী এই কবিতার পঙ্‌ক্তিসমেত ফুল পাঠিয়েছিলেন।

আজ যে সূর্য উঠেছে, তা কেবল একটা নতুন বছরকে আমাদের দরজায় আনেনি, এনেছে একটা নতুন দশককেও। আজ আমরা গত বছরের হিসাব–নিকাশ করার অবকাশ পাচ্ছি। তেমনি গত এক দশকে কী পেলাম, কী হারালাম, সেই হিসাবের খাতাও আজ মেলে ধরা যায় বৈকি। আবার নতুন বছরে নতুন উদ্যমে এগিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণের দিনও আজ।

সৈয়দ শামসুল হক একটা কথা বলেছিলেন, ‘মানুষের ইতিহাসকে দুই–চার বছরের নিরিখে বিচার কোরো না। সামগ্রিকভাবে মানুষের ইতিহাস হলো এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।’ বাংলাদেশের ইতিহাসও এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। চড়াই-উতরাই তো থাকবেই। কিন্তু গত ১০ বছরে আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে ১০৬ ভাগ, দশকজুড়ে আমাদের প্রবৃদ্ধির গড় ৬ দশমিক ৮৮, যা আমাদের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। দারিদ্র্য কমেছে প্রায় ১১ ভাগ। গড় আয়ু বেড়েছে। খাদ্য উৎপাদনে এখন আমরা স্বাবলম্বী। আমাদের ছেলেমেয়েরা প্রায় সবাই স্কুলে যায়, মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার হার ছেলেদের চেয়ে বেশি। আমাদের দেশে প্রায় সবাই স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার করে।

আমরা যা পেয়েছি, তার হিসাব থেকে আমরা প্রেরণা নেব। যা পাইনি, তা অর্জনের চেষ্টাও আমাদের করতে হবে। সে চেষ্টাও নিশ্চয়ই হবে পরিকল্পিত, সুচিন্তিত।

২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ২৬ মার্চ সময়টুকু উদ্‌যাপিত হবে মুজিব বর্ষ হিসেবে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মুজিব বর্ষ উদ্‌যাপনের নানা পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে, বেশ একটা কর্মযজ্ঞ চলছে। যদি বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে তা আমাদের জীবনে কাজে লাগাতে পারি, তা হবে বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ উপায়। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই স্বাধীন দেশে মানুষ যখন পেট ভরে খেতে পাবে, পাবে মর্যাদাপূর্ণ জীবন; তখনই শুধু এই লাখো শহীদের আত্মা তৃপ্তি পাবে।’ এই কথাটা কিন্তু গভীরভাবে ভাবার মতো। আজ যখন পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ থেকে দেখি, কুড়িগ্রামের ৩০ ভাগ মানুষ তিন বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, তখন খুবই বিষণ্ন বোধ করি। আর আছে মর্যাদাপূর্ণ জীবনের কথা। প্রতিটি নাগরিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। এই কথাটার মানে কি আমরা বুঝি! রবীন্দ্রনাথেরই কথা যে, ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান, অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!’ মানুষকে যেন আমরা অপমান না করি।

বঙ্গবন্ধু মুজিব সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছেন। ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। তাঁর প্রকাশিত বই দুটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী আর কারাগারের রোজনামচা আমাদের অবশ্যপাঠ্য। শুধু পড়লেই চলবে না, তাঁর কথাগুলো আমাদের মেনে চলতে হবে। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।’ বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় লিখেছেন, ‘সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে তো কিছুই নাই। এখন ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা শুরু করেছে। পাকিস্তানকে শাসকগোষ্ঠী কোন পথে নিয়ে চলেছে, ভাবতেও ভয় হয়। আজ দলমত-নির্বিশেষে সকলের এই জঘন্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো উচিত।’ (৩০ জুন ১৯৬৬) ১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহীতে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি কী চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসেখেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক।’

সৈয়দ শামসুল হক নূরলদীনের সারাজীবন কাব্যনাটকে যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের কথাই লিখে রেখেছেন:

‘দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,

নবান্নের পিঠার সুঘ্রাণে দ্যাশ ভরি উঠিতেছে।

দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,

হামার গাভীন গাই অবিরাম দুধ ঢালিতেছে।

দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,

মানুষ নির্ভয় হাতে আঙিনায় ঘর তুলিতেছে।

দেখিবার অপেক্ষায় আছোঁ,

নিশীথে কোমল স্বপ্ন মানুষের চোখে নামিতেছে।...

সুখে দুঃখে অন্নপানে সকলেই একসাথে আছে

সোনার বাংলার সোনা বাংলাদেশে আছে।’ 

বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। আমাদের কর্তব্য হবে তাকে অর্থবহ করে তোলা। সে জন্য কী করতে হবে, তা–ও তিনি বলে গেছেন, ‘যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।’ (১৫ জানুয়ারি ১৯৭৫)

২০২০ সালের অঙ্গীকার হোক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, যা মূর্ত আছে আমাদের ১৯৭২-এর সংবিধানের মৌল চার নীতিতে—গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতায়।