নলকূপে পানি ওঠে না, কষ্টে ৫২ গ্রামের মানুষ

কক্সবাজারের পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নে সেচের জন্য বসানো গভীর নলকূপ থেকে পানি সংগ্রহে ব্যস্ত নারী ও শিশুরা। গত সোমবার ইউনিয়নের বামুলাপাড়ায়।
ছবি: প্রথম আলো

সেতেরা বেগম পানির অভাব দূর করতে পাঁচ বছর আগে বসতঘরের আঙিনায় ৯০২ ফুট গভীরতার একটি নলকূপ বসান। গত নভেম্বর থেকে সেই নলকূপে পানি উঠছে না। আধা কিলোমিটার দূরের গভীর নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করছেন। প্রতিবেশীর পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি নেন দৈনন্দিন কাজ সারার জন্য।


সেতেরার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের বামুলাপাড়া গ্রামে। শুধু সেতারার গ্রাম বামুলাপাড়া নয়, উপজেলার রাজাখালী, মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের ৫২টি গ্রামের নলকূপে পানি উঠছে না। মাঝেমধ্যে অল্প পানি উঠলেও তা লালচে, ব্যবহার করা যায় না। এর মধ্যে রাজাখালীর ১৫, মগনামার ১৭ ও উজানটিয়ার ২০ গ্রাম রয়েছে।


জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পেকুয়া উপজেলা কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী জয়প্রকাশ চাকমা বলেন, সাধারণ নলকূপে পানি না ওঠার কয়েকটি কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া, সেচের জন্য যত্রতত্র ১০ ইঞ্চি পুরুত্বের পাইপে গভীর নলকূপ (সাব মার্সিবল পাম্প) বসানো ও অনাবৃষ্টি।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর পেকুয়া উপজেলা কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পেকুয়া উপজেলায় ৫১১টি গভীর নলকূপ বসানো হয়। সরকারিভাবে মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়নে কতটি নলকূপ রয়েছে, সেই হিসাব নেই।
মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শরাফত উল্লাহ চৌধুরী ওয়াসিম, উজানটিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এম শহিদুল ইসলাম চৌধুরী ও রাজাখালী ইউপি চেয়ারম্যান ছৈয়দ নুর বলেন, তিন ইউনিয়নে ৪ হাজার ১১৭টি গভীর-অগভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৯১০টি নলকূপে পানি উঠছে না।


উপসহকারী প্রকৌশলী জয়প্রকাশ চাকমা প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণ নলকূপে পানি উঠছে না বলে স্থানীয় লোকজন প্রতিনিয়ত অভিযোগ নিয়ে আসছেন। তাঁদের অভিযোগ, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কেন নলকূপে পানি উঠছে না, তা চিহ্নিতকরণের কাজ চলছে। সরকারি হিসাবে পানি উঠছে না, এমন নলকূপের সংখ্যা ৫৯টি।


গত সোমবার বিকেলে রাজাখালী ইউনিয়নের পালাকাটা, আমিলাপাড়া, বদিউদ্দিন পাড়া, মাঝিরপাড়া, টেকঘোনা, দশেরঘোনা, নতুনঘোনা, সুন্দরীপাড়া, চঁরিপাড়া, বকশিয়াঘোনা, মিয়াপাড়া, সিকদারপাড়া, রায়ের বাপের পাড়া, চাকলাদারপাড়া, মাতবরপাড়ার বেশির ভাগ নলকূপ শুকনো অবস্থায় দেখা গেছে। এসব নলকূপের আশপাশটাও আয়রনে লালচে আকার ধারণ করেছে। পুরো গ্রামে মোটরচালিত একটি গভীর নলকূপ থাকলে সেখানেই ভিড় করছেন নারী-পুরুষেরা।


রাজাখালী ইউনিয়নে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে সামাজিক বিপ্লব নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের সদস্যসচিব মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, গভীর বা অগভীর নলকূপ বসানো হয় দেড় থেকে তিন ইঞ্চি সাইজের পাইপ দিয়ে। কিন্তু সেচকাজে ব্যবহারের নলকূপে পাইপ দেওয়া হয় ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি সাইজের। এতে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।


রাজাখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম (৭৫) বলেন, আগে সেচকাজে শ্যালো মেশিন বসিয়ে খাল থেকে পানি তোলা হতো। এখন সেসব খাল ভরাট হয়ে গেছে। আবার কিছু খালে লোনাপানি ঢুকিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। সেচকাজে লোনাপানি ব্যবহার রোধ করতে শুকনো মৌসুমে মানুষ বড় পাইপের গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তুলছে।


রাজাখালী ইউনিয়ন ছাড়াও মগনামা ও উজানটিয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ নলকূপে পানি নেই। এ দুটি ইউনিয়নও কুতুবদিয়া চ্যানেলের পার্শ্ববর্তী। এ দুটি ইউনিয়নে দুই বছর ধরে নলকূপে পানি উঠছে না।


মগনামা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য শাহেদুল ইসলাম বলেন, তাঁর এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাংসারিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পুকুর ও বিলের পানি। এ কারণে পেটের পীড়া ও চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে।
পেকুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মুজিবুর রহমান বলেন, উপকূলীয় মগনামা, উজানটিয়া ও রাজাখালী ইউনিয়নের যাঁরা হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসছেন, তাঁদের মধ্যে চর্ম ও পানিবাহিত রোগী বেশি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের হিসাবমতে, রাজাখালীতে ১৭টি, মগনামাতে ২৭টি ও উজানটিয়া ইউনিয়নে ১৫টি সেচপাম্প রয়েছে। এই তিন ইউনিয়নে প্রতি মৌসুমে ৬৯ কোটি ৩৬ লাখ ৪৯ হাজার ৭২৪ লিটার পানি সেচ হয়। তবে জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, বোরো মৌসুমে এই তিন ইউনিয়নে ৯৫টি সেচপাম্প চলে।


জানতে চাইলে পেকুয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তপন কুমার বলেন, ‘সাধারণ নলকূপে পানি না ওঠার বিষয়টি সবাইকে ভাবাচ্ছে। বোরোর সময়ে বিকল্প হিসেবে আমরা ভুট্টা, সূর্যমুখী, শর্ষেসহ রবিশস্য আবাদের ওপর জোর দিচ্ছি। কারণ, এতে পানি কম লাগে।
সংকট মোকাবিলায় ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহারে জোর দিতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পানির উৎসকে ব্যবহার করে ডি-স্যালাইনেশন প্রকল্প (লবণ মুক্তকরণ প্রকল্প) হাতে নিতে হবে। এ উদ্যোগ ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার মাধ্যমে নেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ডি-স্যালাইনেশন প্রকল্প ব্যবহার হচ্ছে। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় সহজে এটি ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে।