না খেয়ে স্কুলে যেত ওরা, কলেজে যেতে পারবে?

মুরাদ আলম (বাঁয়ে) এবং মোরছালিন সরকার (ডানে)
মুরাদ আলম (বাঁয়ে) এবং মোরছালিন সরকার (ডানে)

অভাবের তাড়নায় দুজনেরই খাওয়াদাওয়ার কোনো ঠিকঠিকানা ছিল না। তবে পড়াশোনাটা চালিয়ে গিয়েছিল তারা। ফলও এসেছে হাতেনাতে। নিজেদের স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে তারা। তবে সেই অর্জনের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে কলেজে ভর্তির দুশ্চিন্তায়। কারণ সেই একই—দারিদ্র্য।

এই দুজন হলো মুরাদ আলম (১৬) ও মোরছালিন সরকার (১৭)। মুরাদ রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার লালবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এ বছর বিজ্ঞান বিভাগে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে। অন্যদিকে মোরছালিন তারাগঞ্জ উপজেলার বরাতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে।

মুরাদের বাড়ি উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ঘৃলাই মাস্টারপাড়া গ্রামে। তার বাবা মমিনুল ইসলামের পেশা দিনমজুরি। এসএসসির ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার তিন দিন আগে মুরাদের বাবা ধান কাটতে যান জয়পুরহাট জেলায়। ছেলের জিপিএ-৫ পাওয়ার খবরও ফোনে শুনতে হয়েছে তাঁকে। এর আগে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতেও মেধা বৃত্তি পেয়েছিল মুরাদ। শুধু লেখাপড়ায় নয়। খেলাধুলা ও সৃজনশীল মেধা অন্বেষণসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরা পুরস্কার পেয়েছে সে।

মুরাদের মা মোহসিনা বেগম সংসার সামলান। দুই ভাইয়ের মধ্যে মুরাদ ছোট। বসতভিটা ছাড়া আর কোনো জমি নেই তাদের। মুরাদের বড় ভাই মোরশেদ আলম স্নাতকোত্তর শেষ করতে রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থাভাবে পড়ার খরচ চালাতে না পেরে এখন ঢাকায় পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছেন।

সম্প্রতি মুরাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আধা পাকা ঘরের একপাশে অগোছালোভাবে পড়ে আছে জেলা-উপজেলাভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরার পুরস্কার। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে উপজেলায় সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে মুরাদ। ২০১৮ সালে আন্তমেধা অন্বেষণ এবং রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল সে। খেলাধুলাতেও চৌকস মুরাদ। হ্যান্ডবল, ক্রিকেট ও দৌড় প্রতিযোগিতায় জেলা ও উপজেলায় সেরার পুরস্কার পেয়েছে সে।

মুরাদ প্রথম আলোকে বলে, অনেক কষ্টে পড়াশোনা করে এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছি। খেয়ে, না খেয়ে থাকার কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা আমার আছে। কিন্তু বাইরে ভালো কলেজে পড়তে গেলে, ভর্তি হওয়া ও থাকা-খাওয়ায় টাকা লাগবে। সেই টাকা নেই।

সার্টিফিকেট ও পুরস্কার হাতে মুরাদ আলম। পাশে তাঁর মা। ছবি: প্রথম আলো
সার্টিফিকেট ও পুরস্কার হাতে মুরাদ আলম। পাশে তাঁর মা। ছবি: প্রথম আলো

লালবাড়ি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল হোসেন শাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, মুরাদ মেধাবী ও গরিব ছেলে। তার লেখাপড়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে সহায়তা করেছি, স্কুল থেকেও সহযোগিতা করা হয়েছে। পড়াশোনার সুযোগ পেলে জীবনে সে ভালো কিছু করে দেখাতে পারবে।

মুরাদ আলমকে সহযোগিতা করতে যোগাযোগ করা যাবে এই নম্বরে: ০১৭৬১০৯৭৩৯৪ (বিকাশ)

দিনমজুরির টাকায় পরীক্ষার ফরম পূরণ মোরছালিনের
খেতে ধান কেটে জীবন চলে তার। এরই ফাঁকে ফাঁকে চলত পড়াশোনা। নানা প্রতিবন্ধকতা দূরে ঠেলে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে মোরছালিন সরকার। তার মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসারের খরচ জোগান। অন্যদিকে মোরছালিনের বাবা নাজমুল ইসলাম আগে দিনমজুরি করতেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি এখন কাজ করতে পারেন না।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার হাড়িয়ারকুঠি ইউনিয়নের উত্তর নারায়ণজন গ্রামে মোরছালিনের বাড়ি। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় বরাতি উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মোরছালিন দ্বিতীয়। অষ্টম শ্রেণিতেও ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে সে।

গতকাল মঙ্গলবার মোরছালিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির পাশের খেতে ধান কাটছে মোরছালিন। তার মা গেছেন অন্যের বাড়িতে ধানমাড়াইয়ের কাজ করতে। মোরছালিন প্রথম আলোকে বলে, সুদে দুই হাজার টাকা ধার নিয়ে পরীক্ষার ফরম পূরণ করেছিলাম। সেই টাকা শোধ দেওয়ার জন্য মানুষের বাড়িতে ধান কাটার কাজ করছি। আমার ইচ্ছা পড়ালেখা করে ডাক্তার হব। কিন্তু অভাবের সংসারে সেটা কি সম্ভব?

ছেলের কথা বলতে গিয়ে বাবা নাজমুল ইসলামের চোখের কোণে চিকচিক করে পানি। তিনি বলেন, ‘ছেলেটার ঠিকমতো বই, খাতা, কলম, খাবার দিতে পারি নাই। এ নিয়ে কখনো আক্ষেপ সে করেনি। অন্যের কাছে বই-খাতা ধার করে লেখাপড়া করেছে। প্রায় দিনই না খেয়ে গেছে স্কুলে।’

বরাতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেকেন্দার আলী প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এবং মেধাবী বলে স্কুলে তার বেতন নেওয়া হয়নি। একটু সহযোগিতা পেলে ও অনেক ভালো করবে।

মোরছালিনকে সহযোগিতা করতে চাইলে যোগাযোগ করা যাবে এই নম্বরে: ০১৭৬৩০৫৮৬৪৯ (বিকাশ)