নাপিতকে চিকিৎসকের বিয়ে, মানতেই পারছেন না সিআইডির এই এসপি

গ্রেপ্তারের পর চিকিৎসক, চিকিৎসকের স্বামী ও শিশুকন্যাকে প্রেস কনফারেন্সে হাজির করে সিআইডি
ছবি: সংগৃহীত

রংপুরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাসের বিশ্বাস, একজন নাপিতকে বিয়ে করায় নারী চিকিৎসক অন্যায় করেছেন। স্বাধীনতা আছে বলেই তিনি যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না। তিনি শুধু পরিবার নয়, চিকিৎসক সমাজকে লজ্জায় ফেলেছেন।

২৩ ডিসেম্বর রংপুরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাস নগরীর কেরানীপাড়া এলাকায় সিআইডি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। ওই সম্মেলনে পুলিশ চিকিৎসক, তাঁর নাপিত স্বামী ও সন্তানকে হাজির করেন। তিনি জানান, ওই নারী চিকিৎসকের বাবা চিকিৎসক মেয়ে (৩৪) অপহৃত হয়েছেন বলে মামলা করেছিলেন। প্রায় ২১ মাস পর তাঁদের সবাইকে মোহাম্মদপুর থেকে উদ্ধার করা হয়।  ওই চিকিৎসক একজন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ।

যদিও আদালতে উপস্থাপনের পরপরই ওই নারী জানান, তিনি স্বামী–সন্তান নিয়ে সুখে সংসার করছেন, অপহরণের শিকার হননি। আদালত তাঁর এই বক্তব্যের পরপরই তাঁকে নিজ জিম্মায় ছেড়ে দেন। তাঁর স্বামী এখনো অপহরণ মামলায় কারাগারে। প্রাপ্তবয়স্ক একজন নারী কাকে বিয়ে করেছেন, তা নিয়ে সিআইডির এই সংবাদ সম্মেলন আলোচনার জন্ম দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ আদালতের নির্দেশনা এবং আইন দুই–ই লঙ্ঘন করেছে এমন মন্তব্যও করেছেন নেটিজেনরা।

তবে সংবাদ সম্মেলনের তিন দিন পর এবং এত আলোচনা–সমালোচনার পরও মিলু মিয়া বিশ্বাস দাবি করেছেন, পুলিশ যা করেছে ঠিক করেছে। তিনি শনিবার (২৬ ডিসেম্বর) প্রথম আলোকে বলেন, উনি ভালো চিকিৎসক। তিনি ঢাকায় তিন জায়গায় রোগী দেখতেন। যাঁকে তিনি বিয়ে করেছেন, তিনি লেখাপড়া জানেন না। চিকিৎসকের বাবার ফুটফরমাশ খাটতেন। চিকিৎসকেরও কাজে সাহায্য করতেন। এর আগেও তিনি একবার এই নাপিতের সঙ্গে পালিয়ে যান। পরে বুঝিয়ে–শুনিয়ে প্রথম স্বামীর কাছে ফেরত আনা হয়। তখন তো তিনি ব্যভিচার করেছেন। প্রথম স্বামীকে ভালো না লাগলে তাঁর দ্বিতীয়বার বিয়ে করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু স্বাধীনতা মানে যা ইচ্ছা তা করা নয়।

এ বিষয় নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে হলো কেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, সমাজের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য দরকার ছিল। চিকিৎসকের বাবার কথা ভাবতে হবে। তিনি এত কষ্ট করে মেয়েকে বড় করেছেন, চিকিৎসক বানিয়েছেন তাঁর কথাও তো ভাবতে হবে।

মিলু মিয়া বিশ্বাস আরও বলেন, চিকিৎসক তাঁর প্রথম পক্ষের সন্তানকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। বাবার সঙ্গে কথা বলতে দিচ্ছিলেন না। পরিবারের কারও সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল না। সে জন্যই তাঁকে উদ্ধার করা জরুরি ছিল। এ নিয়ে কি চিকিৎসকের প্রথম স্বামী কোনো মামলা করেছেন? এমন প্রশ্নে সিআইডির পুলিশ সুপার বলেন, মামলা না করলেও তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছেন।

এমনকি পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ খোলাখুলি বলেন, এ ধরনের সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশ নিজেই মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) সোহেল রানা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি দুঃখিত ডা. ...। আপনার অধিকারের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে আমার। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার পছন্দের ব্যক্তিকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারেন। কোনো সঙ্গীকে পছন্দ না হলে নিয়মতান্ত্রিক ও আইনি উপায়ে অপর কোনো সঙ্গী বা বন্ধু বেছে নেওয়ার অধিকার আপনারও রয়েছে, যেমন অধিকার এ দেশে আমি ভোগ করে থাকি প্রতিনিয়ত। আপনি যে নরসুন্দরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন স্বেচ্ছায়, তাঁর প্রতিও রইল শ্রদ্ধা। আমার সীমাবদ্ধতার জন্যও আমি লজ্জিত। বিশাল প্রক্রিয়ার একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র আমি। কিন্তু নিশ্চিত জানবেন, সীমাহীন আঁধারের শূন্যতায় একটি জোনাক পোকা হয়ে হলেও জ্বলছে আমাদের উদ্যোগ।’ ওই মন্তব্যে তিনি যথার্থ মন্তব্য করেছেন বলেও উল্লেখ করেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একাধিক পদস্থ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক স্বেচ্ছায় প্রথম স্বামীকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন। তাঁর বাবা অপহরণের মামলা করলেই তাঁর স্বামীকে গ্রেপ্তার বা সন্তানসহ গোটা পরিবারকে মিডিয়া ট্রায়াল করানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। মামলা হলেও আসামি গ্রেপ্তারে পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তার করবে কি না, সেটা তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। এই ক্ষমতা তাকে দেওয়া হয়েছে। মিডিয়া ট্রায়াল বিষয়ে আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা আছে। ২০১২ সালে একজন বিচারক ফেনসিডিলসহ আটকের পর হাইকোর্ট নির্দেশ দেন যে গ্রেপ্তার বা সন্দেহভাজন হিসেবে আটকের পর কোনো ব্যক্তিকে যেন গণমাধ্যমের সামনে হাজির করা না হয়। তা ছাড়া শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর অবস্থান গোপন রাখা।

এসব প্রশ্নের জবাবে মিলু মিয়া বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, সিআইডির যে ধরনের মামলা করার ক্ষমতা আছে অপহরণ তার মধ্যে পড়ে। মামলাটি প্রথমে থানা তদন্ত করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে দিয়েছিল। এরপর আদালতের নির্দেশে সিআইডি তদন্ত করে। মামলা হয়েছে, তাই তিনি আসামি ধরেছেন। চিকিৎসক নারীর বাবা নানা জায়গায় সিআইডির নামে নিন্দামন্দ করছিলেন। তাই তাঁর ওই নারী চিকিৎসক ও তাঁর সন্তানকে উদ্ধার করে দিয়েছেন। শিশুর সঙ্গে মানবিক ব্যবহার করেছেন। পুলিশ আইন লঙ্ঘন করেনি।

এ বিষয়ে জানতে পুলিশ সদর দপ্তরের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সিআইডি সূত্র জানায়, সংবাদ সম্মেলনের জন্য ঢাকায় সিআইডির মূল কার্যালয়ে কোনো অনুমতি নেননি মিলু মিয়া বিশ্বাস।

অন্যদিকে জাতীয় মানবিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতা থাকলেই যা খুশি তাই করা যায় না। একজন পুলিশ কর্মকর্তা একজন চিকিৎসকের নাপিতকে বিয়ে করা মেনে না নিতে পারেন, সমাজ মেনে না নিতে পারে, কিন্তু আইনের চোখে সবাই সমান। আসলে সবাই এখন গণমাধ্যমে নিজেকে প্রদর্শন করতে চান। এখানেও তা–ই ঘটেছে। যাঁর যা কাজ সে কাজে পারদর্শিতা বা দক্ষতা বেশির ভাগ পেশাজীবীরই কম। অন্য কাজে সক্রিয়তা দেখাতে তাঁরা ভালবাসেন।