নারী নির্যাতন: বিচারকের বিরুদ্ধে আসামির সঙ্গে আপসের জন্য চাপ প্রয়োগের অভিযোগ

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি মামলায় আপস করার জন্য বাদীর ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন বিচারকের বিরুদ্ধে। বাদী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার চেয়েছেন।

ভুক্তভোগী নারী পেশায় একজন আইনজীবী। অন্যদিকে ওই মামলার আসামি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে সহকারী জজ পদে সম্প্রতি সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এর আগে তিনি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের আইন কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলার কার্যক্রম শুরুর পর ওই নারী, তাঁর স্বামী, বান্ধবী ও ছোট বোনের বিরুদ্ধে আসামি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পাল্টা একটি মামলা করেন। এই পাল্টা মামলার শুনানিতে আপসের জন্য বাদীকে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে।

ভুক্তভোগী নারীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় হাইকোর্টে আইনগত সহযোগিতা দিচ্ছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি নিশ্চিত করেছেন, বিচারক তাঁর মক্কেলকে আপস করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে ধারায় তাঁর মক্কেল মামলা করেছেন, তা আপসযোগ্য নয়।

জানা গেছে, বিষয়টি নিয়ে ভুক্তভোগী নারী ৪ এপ্রিল ওই বিচারকের বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি ও রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে চিঠি দিয়েছেন।

ওই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ২০২০ সালের ৪ ডিসেম্বর তিনি কক্সবজার থেকে সেন্ট মার্টিনস পরিবহনে ঢাকা আসছিলেন। সে সময় তিনি কক্সবাজারে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রকল্পে আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন। ওই রাতে আসামি বসেছিলেন তাঁর পাশের আসনে। সে সময় আসামি তাঁকে যৌন নিপীড়ন করেন। অবস্থা প্রতিকূল হলে তিনি ৯৯৯–এ ফোন করেন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া থানা–পুলিশ ওই বাস থেকে তাঁকে উদ্ধার ও আসামিকে আটক করে। ওই ঘটনায় তিনি লোহাগাড়া থানায় একটি মামলা করেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা পেয়েছেন জানিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। মামলাটি এখন চট্টগ্রাম নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২–এ বিচারাধীন।

ওই নারীর অভিযোগ, নামে-বেনামে বিভিন্নভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি তাঁকে হুমকি ও চাপ প্রয়োগ করছিলেন। এর মধ্যেই গত বছরের ২৫ নভেম্বর আসামি বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। ফৌজদারি মামলা চলার তথ্য গোপন রাখা নিয়ে সে সময় খবর বের হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় তাঁর যোগদান স্থগিত করে।

ভুক্তভোগী নারীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় হাইকোর্টে আইনগত সহযোগিতা দিচ্ছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি নিশ্চিত করেছেন, বিচারক তাঁর মক্কেলকে আপস করার জন্য চাপ প্রয়োগ করেছেন। যদিও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে ধারায় তাঁর মক্কেল মামলা করেছেন, তা আপসযোগ্য নয়।

গত বছরের ৭ ডিসেম্বর আসামি ওই নারী, তাঁর স্বামী, ছোট বোন ও বন্ধুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি তাঁরা হাইকোর্ট থেকে চার সপ্তাহের জন্য আগাম জামিন নেন। এক মাস পর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান। আদালত তাঁর স্বামীকে জামিন দিয়ে বাকিদের জেলে পাঠিয়ে দেন। সাত দিন পর তাঁরা জামিনে বের হন।

ওই নারীর অনুপস্থিতিতে আসামি তাঁর স্বামীকে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন ও মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিতে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে একটি অঙ্গীকারপত্রও আদায় করেন যে ভুক্তভোগী নারী আপস করবেন। ৩ এপ্রিল মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজিরার দিন ছিল তাঁদের। ওই দিন তাঁরা জানতে পারেন, আপসে রাজি না হওয়ায় আসামিপক্ষ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় তাঁর জামিন বাতিলের আবেদন করেছে।

ওই নারীর অভিযোগ, সে দিন আদালতে উপস্থিত হলে দুই পক্ষকে তাঁদের পরস্পরের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা আপস করে দুই দিন পর আসতে বলা হয়। বিচারক শুনানির পর নারীকে ৩০ মিনিট সময় বেঁধে দেন আপসের জন্য। নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের মামলা তুলে নেবেন, এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপসনামায় সই করতে বলা হয় তাঁকে।

ওই নারী বলেন, দুই ঘণ্টা পর বিচারক তাঁকে তাঁর স্বামী, আইনজীবীসহ খাসকামরায় ডেকে নেন। সেখানে আপস করতে চাপ দেন। তিনি জানতে পারেন, আসামি বিচারকের পূর্বপরিচিত ছিলেন।

যৌন হয়রানির অভিযোগে করা মামলা তুলে নেওয়ার জন্য কৌশল হিসেবে তাঁর এবং তাঁর পরিবার ও বন্ধুর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওই নারী। তিনি বলেন, বিচারক আসামির সহযোগীর ভূমিকা পালন করেছেন। এটি ‘সুনির্দিষ্ট পেশাগত অসদাচরণ।’

চিঠি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তিনি জানাতে পারবেন। আর ওই নারীর করা মামলার আসামি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিচারাধীন বিষয়ে কথা বলবেন না।

প্রধান বিচারপতি ও রেজিস্ট্রার জেনারেলের কাছে ওই নারী যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে লিখেছেন, ‘আমি এ দেশের নাগরিক হিসেবে এবং আইনজীবী হিসেবে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হব বলে সন্দেহ পোষণ করছি।’

সংশোধনী: এই প্রতিবেদনে ভুলবশত ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন বিচারকের পরিবর্তে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের একজন বিচারক লেখা হয়েছিল। এই ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।